সৌরজগৎ
সৌরজগৎ মানে সূর্যের জগত, সূর্যের পরিবার, তার মধ্যে রয়েছে ৮ টি গ্রহ , ২৯০টি উপগ্রহ, অসংখ্য গ্রহাণু, ধুমকেতু , বামন গ্রহ, ছোট বড় বিভিন্ন শিলাপাথরের খণ্ড। বৈজ্ঞানিকভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, সূর্যের মহাকর্ষ বলের প্রভাব বলয়ের অংশ হল সৌরজগত। সে ক্ষেত্রে সূর্যের প্রভাব বিস্তার করে অনেক দূর, উর্ট মেঘমালা অঞ্চল পর্যন্ত। সূর্যের ৮টি গ্রহ সূর্যকে কেন্দ্র করে ঘুরছে, ঠিক সেই ভাবে সূর্য প্রতি ২৩ কোটি বছরে মিল্কিওয়ে গালাক্সির কেন্দ্রে আবর্তন করে। সূর্য একটি বেশ সাধারন মানের নক্ষত্র, মিল্কিওয়ে গালাক্সির কেন্দ্র থেকে ২৬,০০০ আলোকবর্ষ দূরে রয়েছে। আনুমানিক ১০০ বিলিয়ন নক্ষত্র রয়েছে আমাদের মিল্কিওয়ে গালাক্সিতে, সূর্য তাদের মধ্যে একটি।
গ্রহ
-
বুধ
দূরত্বের দিক থেকে সূর্যের নিকটতম , সৌরজগতের প্রথম গ্রহ ও আকারে সবচেয়ে ছোট গ্রহ। এই প্রাচীন কাল থেকেই মানুষ পর্যবেক্ষণ করে আসছে, প্রায় ৫০০০ বছর পুর্বে প্রাচীন সুমেরিয়া সভ্যতায় এই গ্রহের কথা বর্ণিত রয়েছে। সূর্যের নিকটতম গ্রহ বলে গ্রহের তাপমাত্রা অনেক প্রায় ৪৩০ ডিগ্রী । বুধ গ্রহের একদিন প্রায় পৃথিবীর ১৭৬ দিনের সমান আবার বুধ গ্রহের এক বছর সমান পৃথিবীর ৮৮ দিন। বুধ গ্রহের পৃষ্ঠে দাঁড়ালে সূর্যকে প্রায় ৩গুন বড় দেখাবে। এই গ্রহের কোন উপগ্রহ নেই বা শনি, বৃহস্পতি গ্রহের মত বেই বলয়।
-
শুক্র
সূর্য থেকে দূরত্বের দিক থেকে দ্বিতীয় গ্রহ। আকার, বায়ুমণ্ডল ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্য পৃথিবীর সাথে মিল পাওয়া যায়, সেজন্য অনেকসময় শুক্র গ্রহকে পৃথিবীর যমজ গ্রহ বলে হয়। শুক্র প্রচণ্ড উষ্ণ, বায়ুমণ্ডল অত্যন্ত বিষাক্ত ও পৃষ্টে বিভিন্ন আগ্নেয়গিরি রয়েছে।
-
পৃথিবী
নীল এই গ্রহ, অতি সাধারন, মাঝারি আকারের। রয়েছে বায়ুমণ্ডল, রয়েছে সাগর, ঢেউ , বাতাস , ঝড় বৃষ্টি , আগ্নেয়গিরি ইত্যাদি । কিন্তু এই সাধারন এই গ্রহের রয়েছে আসাধারন বিশিষ্ট, একমাত্র গ্রহ যেখানে প্রান ধারনের অনুকল। পৃথিবী সৌরজগতের তৃতীয় গ্রহ, পৃথিবীর কক্ষপথের এই এলাকা গল্ডিলক এলাকা হিসেবে পরিচিত, এই এলাকার তাপমাত্রা খুব বেশি হয় না, আবার খুব পরম শীতলও হয় না, মোটামুটি আদর্শ এলাকা বলা যেতে পারে।
-
মঙ্গল
সৌরজগতের চতুর্থ গ্রহ, মঙ্গলের সাথে পৃথিবীর বেশ কিছু মিল আছে, যেমন মঙ্গলে ঋতু আছে, আগ্নেয়গিরি ও জলবায়ু আছে। মঙ্গলের বায়ুমণ্ডল অত্যন্ত পাতলা। মঙ্গল একমাত্র গ্রহ যা এই মুহূর্তে রোবটদের দখলে। গ্রহের লালচে রঙের জন্য অতীতে অনেক সভ্যতা এই গ্রহকে যুদ্ধ বা রাগের সাথে তুলনা করতো।
-
বৃহস্পতি
বৃহস্পতি সৌরজগতের পঞ্চম ও বৃহত্তম গ্রহ। এই গ্রহের ভর বাকি সকল গ্রহের ভরের আড়াইগুণ। বৃহস্পতির উপগ্রহের সংখ্যা ও আকারের জন্য এই গ্রহ নিজেই একটা ছোট সৌরজগত গঠন করে। অনেকে বৃহস্পতিকে ব্যর্থ নক্ষত্রও মনে করেন, কারণ রাসায়নিক উপাদান সূর্যের মত ( হাইড্রোজেন ও হিলিয়াম)। কিন্তু পারমানবিক বিক্রিয়া ঘটার মত পর্যাপ্ত ভর নেই।
-
শনি
প্রাচীনকাল থেকে পরিচিত গ্রহের মধ্যে শনি সবচেয়ে দুরবর্তি। ১৬৫৯ সালে ডাচ জ্যোতির্বিজ্ঞানী হাইগেন্স টেলিস্কোপর মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করে শনির বলয়ের ধারনা প্রস্তাব করেন। পরবর্তীতে ১৬৭৫ সালে জ্যোতির্বিজ্ঞানী ক্যাসিনি বলয়ে বিভাজন উদ্ঘাটন করেন , যা পরিচিত হয় বলয়-A এবং বলয়-B ( Ring A and Ring B) হিসেবে। বলয়ে বিভাজনের কারণ, শনির উপরগ্রহ মাইমাসের (Mimas) মহাকর্ষ । শনি গ্রহ বলয়ের জন্য বিখ্যাত, বলয়ে রয়েছে ধুলা বালি, বরফ, পাথুরে কনা ইত্যাদি, ধারনা করা হয় শানি গ্রহের শক্তিশালী মহাকর্ষ বলের প্রভাবে ছোট উপগ্রহ , ধুমকেতু বা গ্রহানু ভেঙ্গে আজকের এই বলয় তৈরি হয়।
-
ইউরেনাস
নীল রঙের ইউরেনাস সৌরজগতের সপ্তম গ্রহ । ১৭৮১ সালে উইলিয়াম হার্শেল প্রথম আবিষ্কার করেন, যদিও প্রথমে তিনি এই গ্রহকে ধূমকেতু বা তারা ভেবেছিলেন। ইউরেনাস সৌরজগতের ২ টি বরফ দানবের একটি ( আরেকটি নেপচুন ) ।
-
নেপচুন
সৌরজগতের অষ্টম ও সর্বশেষ গ্রহ। অন্যান্য গ্যাস দানবের মত নেপচুনও হাইড্রোজেন ও হিলিয়ামে পূর্ণ। ১৮৪৬ সালে নেপচুন আবিষ্কৃত হয়। সূর্য থেকে প্রায় ৪৫০ কোটি কিমি দুরে অবস্থিত , নেপচুন সূর্যকে ১৬৫ বছরে একবার পরিভ্রমণ করে ( নেপচুন বছর ) । পৃথিবী থেকে অনেক দুরে থাকার কারণে খালি চোখে দেখা যায় না। নেপচুনে চৌম্বক ক্ষেত্র পৃথিবী থেকে প্রায় ২৭গুন বেশি শক্তিশালী । নেপচুনে গভীর বায়ুমণ্ডল রয়েছে , পৃথিবী সাদৃশ্য কঠিন কেন্দ্র আছে। বায়ুমণ্ডলে মিথেনের জন্য নেপচুনকে নীল দেখায়। গ্রহের বায়ুপ্রবাহ অনেক শক্তিশালী , পৃথিবী থেকে ৯ গুন ও বৃহস্পতি থেকে প্রায় ৩ গুন শক্তিশালী হতে পারে।
বামন গ্রহ (ছোট গ্রহ বা Dwarft Planet)
-
বামন গ্রহ (ছোট গ্রহ Dwarft Planet)
এই ধরনের গ্রহ গোলাকার , সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে কিন্তু আকারে বেশ ছোট । নেপচুনের পরে কুইপার বেল্ট অঞ্চলে অবস্থান। প্লুটো একটি বামন গ্রহের উদাহরণ। বামন বা ছোট গ্রহ মানে আকারে অন্য গ্রহের তুলনায় ছোট। বামন গ্রহ একটি নতুন সংজ্ঞায়িত শ্রেণী, বিজ্ঞানীরা অনেক নতুন ধরনের গ্রহ পর্যবেক্ষণ করেন এবং এই সংখ্যা আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে। তাই ২০০৬ সালে আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিজ্ঞান ইউনিয়ন গ্রহ ও বামনগ্রহের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে, যার ফলস্বরূপ প্লুটো গ্রহ থেকে বামনগ্রহ শ্রেণীভুক্ত হয়। এই মুহূর্তে সৌরজগতে ৮টি গ্রহ ও ৫টি বামনগ্রহ রয়েছে।
-
প্লুটো
রজগতের একসময়ের নবম গ্রহ হিসেবে পরিচিত ছিল, যদিও এখন প্লুটোকে গ্রহ হিসেবে বিবেচিত করা হয় না, প্লুটোকে এখন বামন গ্রহ বা ছোট গ্রহ হিসেবে ধরা হয়। ১৯৩০ সালে ক্লাইড টম্বাহ প্রথম আবিষ্কার করেন।
-
বামন গ্রহ - সেরেস
সেরেস একটি বামন গ্রহ। মঙ্গল এবং বৃহস্পতির মধ্যে অবস্তিত গ্রহাণু বেষ্টনীর সবচেয়ে বড় বস্তু, বর্তমানে সেরেসকে বামন গ্রহ (dwarf Planet) বা ছোট গ্রহ বলা হয়। আকারে প্লুটোর চেয়ে অনেক ছোট। বাহুদিন পর্যন্ত সেরেস গ্রাহানু হিসেবে পরিচিত ছিল, ২০০৬ সালে আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিদ্যা ইউনিয়ন (IAU - International Astronomical Union) সেরেসকে বামন গ্রহ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
সূর্য, ধুমকেতু, গ্রহাণু ইত্যাদি
-
সূর্য
সূর্য একটি নক্ষত্র , সৌরজগতের কেন্দ্রে অবস্থিত একটি গ্যাসীয় গোলাকার পিণ্ড। সূর্যের তাপ এবং শক্তি ছাড়া পৃথিবীতে প্রাণের অস্তিত্ব সম্ভব হত না। সূর্যের মত কোটি কোটি নক্ষত্র মহাবিশ্বে বিদ্যমান। সূর্য পৃথিবীর শক্তির উৎস।
-
ধূমকেতু
ধূমকেতু হিমায়িত গ্যাস, শিলা ও ধূলিকণা দ্বারা গঠিত। ধূমকেতু সূর্যের নিকটবর্তী হলে, সূর্যের তাপের কারণে গ্যাস ও ধূলিকণার মিশ্রণে বিশাল লেজের সৃষ্টি করে, যা কয়েক লক্ষ কিলোমিটার হতে পারে।
-
গ্রহাণু
পাথুরে, বায়ুশূন্য বস্তু যা মঙ্গল ও বৃহস্পতি গ্রহের মধ্যে অবস্থিত, সাধারণত আকারে ছোট। গ্রহানু হলো সৌরজগতের অংশ, ছোট গ্রহ, পাথুরে বস্তু যা সাধারনত মঙ্গল গ্রহ ও বৃহস্পতি গ্রহের মধ্যে অবস্থান। আনুমান করা হয় প্রায় ১৩ লক্ষ গ্রহানু রয়েছে। মঙ্গল ও বৃহস্পতি গ্রহের মধ্যের এই অঞ্চলকে গ্রহানু বলয় বলে। বিভিন্ন আকারের গ্রহানু রয়েছে, ছোট যেমন মাত্র ১০ মিটার ব্যাসার্ধের আবার বড় আকারেরও গ্রহানু আছে যেমন ভেস্তা যার ব্যাসার্ধ প্রায় ৫৩০ কিমি।
উপগ্রহ
-
চাঁদের কথা
চাঁদ পৃথিবীর একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহ। পৃথিবীর উপর চাঁদের প্রভাব অনেক। পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তন, জোয়ার - ভাটা এবং পৃথিবীর স্থিতিশীল অক্ষের উপর চাঁদের প্রভাব অনেক। চাঁদ সৌরজগতের পঞ্চম বৃহত্তম উপগ্রহ। পৃথিবী ছাড়া একমাত্র স্থান/গ্রহ/উপগ্রহ যেখানে মানুষ প্রদার্পন করেছে।
-
গ্যানিমিড
গ্যানিমিড – সৌরজগতের সবচেয়ে বড় উপগ্রহ, আকারে আমাদের চাঁদ থেকে বেশ বড়, এমনকি বুধ গ্রহ থেকেও বড়। আপাত দৃষ্টিতে গ্যানিমিডকে নির্জীব, বিরান মনে হলেও তার রয়েছে বেশ কিছু আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য যেমন একমাত্র উপগ্রহ যার রয়েছে নিজস্ব চৌম্বকক্ষেত্র , ধারনা করা হয় গ্যানিমিডের ভূপৃষ্ঠের নিচে রয়েছে গভীর সমুদ্র যার গভীরতা প্রায় ১৫০ কিমি।
-
ট্রাইটন (Triton)
ট্রাইটন – নেপচুনের একটি রহস্যময় ও আকর্ষণীয় উপগ্রহ। সৌরজগতের এক প্রান্তে পড়ে থাকা একটি উপগ্রহ প্রথম আবিষ্কার করেন ব্রিটিশ সৌখিন জ্যোতির্বিজ্ঞানী উইলিয়াম ল্যাসেল (William Lassell) । নেপচুন আবিষ্কারের মাত্র ১৭ দিন পর ১৮৪৬ সালের ১০ ই অক্টোবর টেলিস্কোপের মাধ্যমে ট্রাইটন আবিষ্কার করেন। ট্রাইটন কিছুটা অদ্ভুত, যেমন এটি উল্টা দিকে নিজের গ্রহ নেপচুনকে আবর্তন করে, এটা সৌরজগতের সবচেয়ে শীতল স্থান।
-
ইউরোপা : প্রাণ ধারণের কি উপযোগী ?
বৃহস্পতি গ্রহের এই উপগ্রহ বিজ্ঞানীদের আলোচনার কেন্দ্র বিন্দু , আলোচনা থাকার কারণও রয়েছে, ধারনা করা হয়, এই উপগ্রহের ভিতর রয়েছে তরল সাগর। তরল সাগর প্রাণ ধারণের একটি আবশ্যিক উপাদান পৃথিবীতে, তাহলে কি এই উপগ্রহেও সম্ভব প্রাণ ? এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার চেষ্টা চলছে। প্রান ধারনের জন্য তিনটি জিনিস প্রয়োজনীয়ঃ তরল পানি , রাসায়নিক উপাদান এবং শক্তির উৎস।
-
টাইটানের হ্রদ
শনির উপগ্রহ টাইটান , এই উপগ্রহে তরল হাইড্রোকার্বনের সমুদ্র ও হ্রদ হয়েছে। জানামতে পৃথিবীর ছাড়া শুধু টাইটানেই সমুদ্র ও হ্রদ পাওয়া গিয়েছে, ক্যাসিনি মিশনের পর্যবেক্ষণে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। তাপমাত্রা প্রায় –180°C টাইটানের সমুদ্র প্রধানত তরল মিথেন ও ইথেনের। কিন্তু এই নিম্নাচল 'জলাধার' কিভাবে সৃষ্টি হল ?
-
আইও (Io)
আইও (Io)
জীবন্ত আগ্নেয়গিরিপূর্ণ একটি সতেজ জীবন্ত উপগ্রহ, বৃহস্পতি গ্রহের উপগ্রহ। আইও বৃহস্পতি গ্রহের একটি অন্যতম উপগ্রহ। আইও ১৬১০ সালে ইতালির বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলি আবিষ্কার করেন। গ্যালিলি ৪ টি বৃহস্পতি উপগ্রহ সনাক্ত করেন, তার সম্মানে এই চারটি উপগ্রহকে গ্যালিলির উপগ্রহও বলা হয়, বাকি তিনটি হলো গ্যানিমিড , ক্যালিস্টো ও ইউরোপা।
-
ইউরোপা
ইউরোপা – বৃহস্পতি গ্রহের একটি উপগ্রহ, কিন্তু এটা কোন সাদামাটা বিরান উপগ্রহ নয়।বৃহস্পতি গ্রহের জানামতে ৯৫ টি উপগ্রহ আছে, কিন্তু তাদের মধ্যে ৪ টি উপগ্রহ (আইও, গ্যানিমিড, ক্যালিস্টো ও ইউরোপা) অনেক আগে থেকেই মানুষের চেনা ছিল, বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলি প্রথম পর্যবেক্ষণ করেন, তাই এদেরকে গ্যালিলিওর চাঁদ ও বলা হয়। তবে ইউরোপা তদের মধ্যে আলাদা ও আকর্ষণীয়। বললে হয়ত ভুল হবে না, সৌরজগতের সবচেয়ে আকর্ষণীয় উপগ্রহ হল এই ইউরোপা। এই মুহর্তে নাসা ও ইসা আলাদা ভাবে দুটি নভোযান প্রেরন করেছে আরও গভীর গবেষণার জন্য।