ধূমকেতু
চিত্রঃ হ্যালির ধুমকেতুর পথ (কম্পিউটার সিমুলেসন ), প্রায় প্রতি ৭৬ বছর পর পর হ্যালির ধুমকেতুর আবির্ভাব হয়। Image Credit: NASA
ধূমকেতু হিমায়িত গ্যাস, শিলা ও ধূলিকণা দ্বারা গঠিত। ধূমকেতু সূর্যের নিকটবর্তী হলে, সূর্যের তাপের কারণে গ্যাস ও ধূলিকণার মিশ্রণে বিশাল লেজের সৃষ্টি করে, যা কয়েক লক্ষ কিলোমিটার হতে পারে।
প্রাচীনকালে মানুষ মনে করতো এই বিশ্ব একটি ছন্দতে চলছে, সব কিছুতে রয়েছে সাম্যাবস্থা। যেমন সূর্য উদয়, অস্ত যাওয়া, চাদের পক্ষ, অন্য গ্রহ নক্ষত্রের বিচরন। সবকিছুতেই ছিল তাদের মত করে দেওয়া ব্যাখ্যা। কিন্তু আপাত দৃষ্টিতে এই ছন্দপতন ঘটত ধুমকেতুর জন্য, ধুমকেতুর আবির্ভাব হত হঠাৎ করেই আবার কিছুদিন পরে অদৃশ্য হয়ে যেত, যার ভাল কোন ব্যাখ্যা জানা ছিল না কারো। ধুমকেতু মানুষ শুরুর দিক থেকেই আগ্রহভরে পর্যবেক্ষণ করে আসছে। ধুমকেতুর আবির্ভাবে মানুষ মনে করতো আশনি সংকেত আবার অনেকে মনে করতে স্রষ্টার কোন বার্তা। প্রাচীন অনেক সভ্যতা মনে করতো ধুমকেতুর আবির্ভাব মানে ঝড়, বন্যা, যুদ্ধ, প্রাকিতিক দূর্যোগের সংকেত। ব্যাবিলনের মহাকাব্য গিলগামেসে ধুমকেতুর আগমনের সাথে আগুন ও বন্যার সাথে সম্পর্কিত বলে মনে করা হত। সুইজারল্যান্ডে বিখ্যাত হ্যালির ধুমকেতুকে দায়ী করা হয় ভুমিকম্প, জরার জন্য। রোমানরা ধুমকেতুকে দায়ী করে পাম্পেই ও সিজারের যুদ্ধ্যের চরম রক্তপাতের জন্য। প্রাচীন চীনারাও ধুমকেতুর বিস্তারিত রেকর্ড রেখে যান, তারা বলত “লম্বা লেজযুক্ত তিতির” আবার অনেকে বলত “ মন্দ বা দুষিত তারা ”। গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল মনে করতেন, ধুমকেতু আসলে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল থেকে সৃষ্টি। এই ভুল ধারনা থেকে বের হতে অনেক সময় অপেক্ষা করতে হয়, ১৫৭৭ সালে ডেনমার্ককের বিজ্ঞানী টাইকো ব্রাহে প্রমান করে দেখান যে, ধুমকেতু আসলে আলাদা বস্তু এবং পৃথিবী থেকে অনেক দূরে অবস্থিত। প্রথম দিকে অনেক বিজ্ঞানীরা মনে করতেন ধুমকেতু সরল পথে চলে, যদিও পরে বুঝতে পারেন যে, ধুমকেতু আসলে উপবৃত্তাকার পথে চলে। ১৬৮০ সালে একটি বড় ধুমকেতু আবির্ভূত হয়, এডমন্ড হ্যালি গননা করে পূর্বাভাস করেন এই ধুমকেতুটি আবার ১৭৫৮ সালে ফিরে আসবে, ঠিক ১৭৫৮ সালে ফিরে আসে সেই ধুমকেতুটি, তার স্মরণে এই ধুমকেতুকে হ্যালির ধুমকেতু বলা হয়। সর্বশেষ ১৯৮৬ সালে এই ধুমকেতু দেখা গিয়েছিল, এই ধুমকেতু আবার ফিরে আসবে ২০৬১ সালে। ১৯৫০ সালে ডাচ বিজ্ঞানী জেন হ্যান্ড্রিক উর্ট ধারনা করেন, দীর্ঘ মেয়াদী ধুমকেতুর আবির্ভাব হয় ১.৬ আলোকবর্ষ দূর থেকে, যা এখন উর্ট মেঘমালা এলাকা হিসেবে পরিচিত। এখনো পর্যন্ত ৩৯৪৪ টি ধুমকেতু সনাক্ত করা হয়েছে [1]।
তথ্য
শর্ট- পিরিয়ড ধূমকেতু ( সূর্য প্রদক্ষিণ সময়কাল ২০০ বছর বা তার কম) কুইপার বেল্ট অঞ্চলে পাওয়া যায়, কুইপার বেল্ট নেপচুনের পরে অবস্থিত, সূর্য থেকে দূরত্ব ৩০ থেকে ৫৫ AU (1 AU (Astronomical Unit) = পৃথিবী থেকে সূর্যের দূরত্ব ১৫ কোটি কিমি).
লং-পিরিয়ড ধূমকেতুর উৎপত্তি উর্ট মেঘমালা (Oort Cloud) অঞ্চলে, যা সূর্য থেকে ৫০০০ থেকে ১ লক্ষ AU দূরত্বে অবস্থিত।
ধূমকেতুর দিন-রাত (আবর্তন নিজের অক্ষ্যে) ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে, হ্যালির ধূমকেতুর দিন ২.২ থেকে ৭.৪ পৃথিবীর দিনের সমান। হ্যালির ধূমকেতু সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করতে ৭৬ বছর সময় লাগে।
ধূমকেতু প্রাণ ধারণের উপযোগী নয়, কিন্তু ধূমকেতু প্রাণের জন্য মূল্যবান পানি ও জৈব ধারণ করে ও পরিবহন করে, হয়ত ধূমকেতুর মাধ্যমে পানি ও জৈব যৌগ পৃথিবীতে এসেছিল।
গঠন: প্রধানত বরফ , জৈব যৌগ দ্বারা তৈরি ।
চিত্রঃ সৌরজগতে কাইপার বেল্ট ও উর্ট মেঘমালা এলাকার অবস্থান। Image Credit: NASA
উৎপত্তি ও অবস্থান
ধূমকেতু আসলে সৌরজগতের উচ্ছিষ্ট, যা ৪৬০ কোটি বছর আগের , সৌরজগত সৃষ্টির শুরুতেই ।
ধূমকেতুর অবস্থান কুইপার বেল্ট ও ওর্ট মেঘমালা অঞ্চলে।
কুইপার বেল্ট নেপচুন গ্রহের পর অবস্থিত , মাঝে মাঝে মহাকর্ষ বলের প্রভাবে অথবা সংঘর্ষের ফলে সৌরজগতের অভ্যন্তরে চলে আসে এবং সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে শুরু করে। সূর্যকে একবার পরিভ্রমণ করতে ২০০ বছরের কম সময় নেয়, এই ধরনের ধূমকেতু শর্ট-পিরিয়ড ধূমকেতু নামে পরিচিত। এই অঞ্চল সূর্য থেকে ৩০- ৫৫ AU (1 AU= Distance between Sun and the Earth ) দূরত্বে অবস্থিত। এই শর্ট পিরিয়ড ধুমকেতুর উদাহরনঃ Comet 67P (6.7 Years) , Comet Encke (3.3 Years) , Comet Swift-Tuttle (133 years) and Halley (76 years)।
ওর্ট মেঘমালা অঞ্চল সূর্য থেকে প্রায় ৫০০০ থেকে ১০০,০০০ AU (1 AU: সূর্য ও পৃথিবীর গড় দূরত্ব) দূরত্বে অবস্থিত, এই অঞ্চল থেকে সৃষ্টি হাওয়া ধূমকেতু লং-পিরিওড ধূমকেতু হয়, এই ধূমকেতুর কক্ষপথ অনেক লম্বা, এমনকি কিছু কিছু ধূমকেতুর সূর্যকে পরিভ্রমণ করতে ৩ কোটি বছর সময় লাগতে পারে। উদাহরনঃ হেল-বপ (আবর্তন কালঃ ২৩০০ থেকে ৪২০০ বছর), হাইকুতাকি ,এটলাস ( ৬০০০ বছর)।
প্রভাব
ধূমকেতু সৌরজগত সৃষ্টির আদি বস্তু, ধূমকেতু গবেষণার মাধ্যমে সৌরজগতের গঠন সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যেতে পারে। হয়ত ধূমকেতু পৃথিবীতে পানি ও প্রাণ ধারণের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান বয়ে এনেছিল।
ধুমকেতুতে স্যাটেলাইট মিশনঃ
ICE: ১৯৭৮ সালে পাঠানো হয় comet 21P/Giacobini–Zinner কে ফ্লাই-বাই করার জন্য। মিশনটি নাসা ও ইসা যৌথ ভাবে পাঠায়।
Vega1 and Vega 2: রাশিয়া ১৯৮৬ সালে হ্যালির ধুমকেতু পর্যবেক্ষণের জন্য পাঠায়।
Sakigake: জাপান ১৯৮৬ সালে হ্যালির ধুমকেতু পর্যবেক্ষণের জন্য পাঠায়।
Giotto: ইসা প্রেরিত এই স্যাটেলাইট হ্যালির ধুমকেতুকে মাত্র ৬০৫ কিমি দূর থেকে ফ্লাই-বাই করে।
Rosetta: ইসা ২০০৪ সালে এই স্যাটেলাইট প্রেরন করে comet 67P/Churyumov–Gerasimenko এর উদ্দেশে এবং ২০১৪ সালে একটি ল্যান্ডার ধুমকেতুর পৃষ্ঠে অবতরন করে।
Deep Impact: এই মিশনে ইচ্ছাকৃত ভাবে ধুমকেতু 9P/Tempel এর সাথে সংঘর্ষ বাঁধায় গবেষণার জন্য।
Comet Interceptor: ইসা (European Space Agency) ২০২৯ সালে এই মিশন পাঠানোর পরিকল্পনা করেছে।
-
হ্যালির ধূমকেতু সবচেয়ে পরিচিত , প্রতি ৭৬ বছর পর পর একবার সূর্যকে একবার আবর্তন করে।
-
এটি দীর্ঘ মেয়াদি ধূমকেতু , সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করতে প্রায় ৭০,০০০ বছর সময় লাগে। ১৯৯৬ সালে ধূমকেতু পৃথিবীর সন্নিকটে এসেছিল (১৪.৮ মিলিয়ন কিমি) , এটা পৃথিবীর সন্নিকটে আবার ফিরে আসবে ৭১,৯৯৬ সালে
-
এটি দীর্ঘ মেয়াদি ধূমকেতু ( long period comet) , সূর্যকে প্রদক্ষিণ করতে প্রায় ২৫০০ বছর সময় নেয়।
তথ্য সূত্র
[1] “Comets - NASA Science.” Available: https://science.nasa.gov/solar-system/comets/.
[2] “Comet from 16 km.” Available: https://www.esa.int/ESA_Multimedia/Images/2016/09/Comet_from_16_km.
[3] H. Hornung and M. P. Society, “Comets play a role in the history of civilization.” Available: https://phys.org/news/2013-11-comets-role-history-civilization.html.
[4] “Deep Impact: Science: Comets in Ancient Cultures.” Available: https://deepimpact.astro.umd.edu/science/comets-cultures.html.
[5] “The origin of comets | Britannica.” Available: https://www.britannica.com/summary/comet-astronomy.