শুক্র গ্রহ

সূর্য থেকে দূরত্বের দিক থেকে দ্বিতীয় গ্রহ। আকার, বায়ুমণ্ডল ও অন্যান্য বৈশিষ্ট্য পৃথিবীর সাথে মিল পাওয়া যায়, সেজন্য অনেকসময় শুক্র গ্রহকে পৃথিবীর যমজ গ্রহ বলে হয়। শুক্র প্রচণ্ড উষ্ণ, বায়ুমণ্ডল অত্যন্ত বিষাক্ত ও পৃষ্টে বিভিন্ন আগ্নেয়গিরি রয়েছে।

শুক্র গ্রহ সৌরজগতের দ্বিতীয় গ্রহ, পৃথিবী থেকে সহজে দৃশ্যমান । অনেকদিক থেকেই শুক্র গ্রহের সাথে পৃথিবীর মিল পাওয়া যায় , সেজন্য শুক্র গ্রহকে পৃথিবীর যমজ গ্রহও বলে অভিহিত করা হয়। শুক্র গ্রহ সন্ধ্যাতারা ও শুকতারা নামেও পরিচিত। শুক্র গ্রহের সাথে পৃথিবীর বেশ কিছু মিল রয়েছে, যেমন আকার – ব্যাসার্ধ ৬০৫১ কিমি (পৃথিবীর ব্যাসার্ধ ৬৩৭১ কিমি), শুক্র গ্রহের বায়ুমণ্ডল রয়েছে যদিও সেখানে প্রান ধারনের মত আবহাওয়া নেই এখন, হয়ত কয়েকশত কোটি বছর আগে শুক্র গ্রহে প্রান ধারনের মত উপযোগী আবহাওয়া ছিল। বুধ গ্রহের মত শুক্র গ্রহেরও কোন উপগ্রহ নেই। আকারের মিল থাকলেও অন্য অনেক কিছুতেই অমিল শুক্র গ্রহের সাথে। যেমন, তাপমাত্রা এত বেশি এমনকি সীসাও গলে যাবে।  শুক্র গ্রহের দিন রাত, বছর, ঋতু বড়ই অদ্ভুত। যেমন, শুক্র গ্রহ সূর্যের চারপাশে একবার ঘুরে আসতে সময় নেয় ২২৫ দিন, কিন্তু নিজের অক্ষে একবার পাক খেতে সময় লাগে ২৪৩ দিন। তার মানে, শুক্র গ্রহের একদিন (২৪৩ পৃথিবীর দিন) এক বছরের (২২৫ পৃথিবীর দিন) চেয়েও বড়। শুক্র গ্রহে ঋতু পরিবর্তনের কোন বালাই নেই। এই গ্রহে সকাল থেকে সন্ধ্যা হতে সময় নেয় ১১৭ দিন (পৃথিবীর দিন)। পৃথিবীতে যেমন গ্রীষ্ম, বর্ষা, শীত এইরকম বিভিন্ন ঋতু আসে যায়, এর কারন পৃথিবী নিজের অক্ষে ২৩ ডিগ্রী কোনে হেলে থাকে, ঠিক এই হেলে থাকার কারনেই আমাদের ঋতু পরিবর্তন হয়, কিন্তু শুক্র গ্রহ তার অক্ষে মাত্র তিন ডিগ্রী কোনে হেলে থাকে, মানে সারা বছর সূর্য সরাসরি তাপ দেয়, কোন ঋতু পরিবর্তন হয় না।

গঠনগত দিক থেকে শুক্র গ্রহের সাথে পৃথিবীর একটু মিল রয়েছে, যেমন কেন্দ্র যার মুল উপাদান হল লৌহ, ভূপৃষ্ঠের ধরনও কাছাকাছি, ভূপৃষ্ঠের ধরন বদলায়, রয়েছে আগ্নেয়গিরি। কার্বন-ডাই-অক্সাইডে পুর্ন বায়ুমণ্ডল এই গ্রহ সৌরজগতের সবচেয়ে উষ্ণ গ্রহ, এমনকি বুধ গ্রহের চেয়েও বেশি উষ্ণ শুক্র গ্রহ। যদিও শুক্র গ্রহের রয়েছে লৌহ-কেন্দ্র কিন্তু নিজস্ব চৌম্বক ক্ষেত্র নেই।  

গুরুত্তপুর্ন তথ্য

 

  • আকারে পৃথিবী থেকে সামান্য ছোট

  • সৌরজগতের দ্বিতীয় গ্রহ , দূরত্ব ১০ কোটি ৮ লক্ষ কিমি ( 0.৭২  AU)

  • শুক্র গ্রহের ১ দিন পৃথিবীর ২৪৩ দিনের সমান ( নিজের অক্ষে একবার পুর্ন আবর্তন )

  • শুক্র গ্রহের ১ বছর পৃথিবীর ২২৫ দিনের সমান ( কক্ষ পথে সূর্যকে একবার পরিভ্রমণ করতে যে সময় লাগে ) ।

  • বায়ুমণ্ডল - কার্বন-ডাই- অক্সাইড এবং নাইট্রোজেন ।  বায়ুমণ্ডলে রয়েছে সালফিউরিক এসিডের মেঘ।

  • কোন উপগ্রহ নেই।

  • এখনো পর্যন্ত প্রায় ৪০ টি মহাকাশযান শুক্র গ্রহে পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা পরিচালনা করেছে।

  • গ্রহে সর্বোচ্চ্ তাপমাত্রা প্রায় ৪৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ।

  • শুক্র নিজের অক্ষে উল্টা ভাবে ঘুরে অন্যান্য গ্রাহের সাপেক্ষে । এইজন্য গ্রহে পশ্চিমে সূর্যোদয় ও পুর্বে সূর্যাস্ত হয়।

বর্ণনা

পরিসংখ্যান


আবিষ্কার সাল - অজানা

পেরিহেলিওল - ১০৭,৪৭৬,১৭০ কিমি

এপিহেলিওন - ১০৮, ৯৪২,৭৮০ কিমি

বছরের দৈর্ঘ্য - ২২৪.৭০ পৃথিবীর দিন

কক্ষপথে গড় গতিবেগ - ১২৬,০৭৪ কিমি / ঘণ্টা

গড় ব্যাসার্থ - ৬০৫১.৮ কিমি

আয়তন - ৯২৮,৪১৫,৩৪৫,৮৯৩ কিমি৩

ভর -

ঘনত্ব- ৫.২৪৩ গ্রাম/সেমি৩

অভিকর্ষ বল - ৮.৮৭ মিটার/সেকেন্ড২

( পৃথিবীতে কোন বস্তুর ওজন ১০০ পাউন্ড হলে শুক্র গ্রহে তার ওজন হবে ৯১ পাউন্ড )

মুক্তিবেগ - ৩৭,২৯৬ কিমি/ঘণ্টা

তাপমাত্রা - ৪৬২ ডিগ্রি সেলসিয়াস

বায়ুমণ্ডলের উপাদান - CO2, N2

বর্ণনা

শুক্রগ্রহ ও পৃথিবীর অনেক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে মিল রয়েছে , যেমন ভর, ঘনত্ব এবং অভিকর্ষ বল । কিছু মিল থাকলেও অনেক ক্ষেত্রে অমিল বিদ্যমান যেমন বায়ুমণ্ডল অত্যন্ত উত্তপ্ত যে তাপমাত্রায় এমনকি সীসা পর্যন্ত গলে যায় , বায়ুমণ্ডলের চাপ পৃথিবীর প্রায় ৯০ গুন । শুক্র আকাশের সবচে উজ্জল গ্রহ। বায়ুমণ্ডলের জন্য শুক্রগ্রহকে সরাসরি দেখা যায় না, কিন্তু নাসার প্রেরিত Megellan মিশন রাডারের মাধ্যমে পৃষ্টের প্রায় ৯৮%   চিত্র ধারণ করে। Galileo মিশন ইনফারেড ক্যামেরার মাধ্যমে পৃষ্ট ও মেধের গঠন ম্যাপ করে । ১৯৯০ সালে ESA (European space agency) প্রেরিত Venus Express মিশন ইনফারেড ইমেজে কয়েক লাখ বছর আগে আগ্নিয়াগিরির প্রমাণ , হয়ত এখনো জীবিত আগ্নিয়াগিরি আছে।

ট্রানজিট

নিয়মিত বিরতিতে শুক্র গ্রহ পৃথিবী ও সূর্যের মধ্যে অতিবাহিত হতে দেখা যায়, এই ঘটনাকে ট্রানজিট বলে, এর পূর্বে ১৬৩১, ১৬৩৯, ১৭৬১ , ১৮৭৪ এবং ১৮৮২ সালে ট্রানজিট দেখা গিয়েছে। এই শতাব্দীতে প্রথম ট্রানজিট হয়েছে ৮ই জুন ২০০৪,দ্বিতীয়  ট্রানজিট  ৬ই জুন ২০১২ সালে হয়েছে। পরবর্তি ট্রানজিট ১১ই ডিসেম্বর ২১১৭ হবে।

বায়ুমণ্ডল

শুক্র গ্রহের বায়ুমণ্ডলের প্রধান উপাদান কার্বন-ডাই-অক্সাইড এবং মেঘ সালফিউরিক এসিডের । অতি সামান্য পানির অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছে। বায়ুমণ্ডল তাপ ধরে রাখে তাই পৃষ্টের তাপমাত্রা এমনকি ৪৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের উপর উঠে। এই পর্যন্ত যে কিছু মহাকাশযান শুক্র গ্রহে অবতরণ করতে সামর্থ্য হয়েছে , তাদের একটিও ২ ঘণ্টার বেশি টিকতে পারেনি প্রচণ্ড তাপের কারণে। গ্রহের মেঘে সালফার যৌগের আধিক্য দেখা যায়। বিজ্ঞ্যানীরা বায়ুমণ্ডলে বজ্রপাতের প্রমাণ পেয়েছেন।

শুক্র বছর

শুক্রগ্রহের বছর পৃথিবীর ২৪৩ দিনের সমান। নিজ অক্ষ কেন্দ্র করে ২৪৩ দিনে আবর্তন করে। এই গ্রহের ঘুর্নন পুর্ব থেকে পশ্চিম। এই ধরনের ঘুর্ননকে রেট্রোগ্রেড (Retrograde) বলে , যেখানে পৃথিবীর ঘুর্নন দিক পশ্চিম থেকে পুর্ব  (Protograde) । শুক্র গ্রহে সূর্যোদয় পশ্চিমে এবং সূর্যাস্ত পুর্ব দিকে হয়।

ভুপৃষ্ট

শুক্রের পৃষ্টে অসংখ্য খাদ রয়েছে মূলত উল্কাপাতের কারণে সৃষ্টি। ধারনা করা হয় , আগ্নেয়গিরির কারণে ৩০-৪০ কোটি বছর আগে নতুন পৃষ্ট সৃষ্টি হয়েছে। শুক্রের দুটি পার্বত্যাঞ্চল আছে, ঈশটার টেরা (Ishtar Terra) এবং এপ্রোডাইট টেরা(Aphrodite Terra) । উত্তর মেরুতে অবস্তিত ঈশটার টেরা আকারে প্রায় অস্ট্রেলিয়ার সমান এবং এপ্রোডাইট টেরা আকারে  প্রায় দক্ষিণ আমেরিকার সমান। শুক্রের উঁচু শৃঙ্গ ম্যাক্সওয়েল মনটেজ। শুক্রের চৌম্বক ক্ষেত্র নেই, এক কারণ অত্যন্ত ধীর গতির ঘুর্নন।

অভিযান

যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া বেশ কিছু নভোযান শুক্র গ্রহের উদ্দেশে প্রেরণ করেছে। প্রথম সফল নভোযান প্রেরণ করে নাসা মেরিনার-২ এর দিয়ে, তারপর রাশিয়া প্রেরিত ভেনিরা মিশনগুলু সফল ভাবে শুক্র গ্রহের কক্ষপথে , বায়ুমণ্ডলে এবং ভূপৃষ্ঠে অবতরণ করে। ​

মেরিনার -২ , নাসা প্রেরিত প্রথম শুক্র গ্রহের উদ্দেশে নভোযান, ১৪ই ডিসেম্বর ১৯৬২ সালে শুক্র গ্রহকে অতিক্রম করে যায় । 

মেরিনার -৫ , নাসা, ১৯৬৭ সালের ১৯শে অক্টোবর গ্রহকে অতিক্রম করে যায়। 

ভেনিরা -৫ , রাশিয়া, রাশিয়া প্রেরিত মহাকাশযান ১৯৬৯ সালের ১৬ই মে শুক্র গ্রহের বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে এবং ৫৩ মিনিট পর্যন্ত মহাকাশযান                      চালু ছিল। 

ভেনিরা-৬, রাশিয়া, মহাকাশযানটি ১৭ই মে ১৯৬৯ সালে শুক্র গ্রহের বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে এবং ৫১ মিনিট কার্যক্ষম ছিল। 

ভেনিরা-৮, রাশিয়া, মহাকাশযানটি ২২শে জুলাই ১৯৭২ সালে শুক্র গ্রহের ভূপৃষ্ঠে অবতরণ করে।

ভেনিরা-৯, রাশিয়া,নভোযান ২০শে অক্টোবর ১৯৭৫ সালে অবতরণ করে শুক্র গ্রহের পৃষ্ঠে। 

ভেনিরা-১০, রাশিয়া, নভোযান ২৩ শে অক্টোবর ১৯৭৫ সালে অবতরণ করে শুক্র গ্রহের পৃষ্ঠে।   

পাইওনিয়ার - ১ এবং ২ , নাসা/যুক্তরাষ্ট্র , ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বরে শুক্র গ্রহের কক্ষপথে পৌছায়। 

ভেনিরা -১৩ এবং ১৪, রাশিয়া, ১৯৮২ সালের মার্চ মাসে দুইটি নভোযান শুক্র গ্রহের পৃষ্ঠে অবতন করে। 

ভেনিরা -১৫ এবং ১৬, রাশিয়া, ১৯৮২ সালের অক্টোবরে এই দুটি নভোযান শুক্র গ্রহের কক্ষপথে পৌছায়। 

ভেগা - ১ &ও ২, রাশিয়া, ১৯৮৫ সালের জুনে মাসে গ্রহের পৃষ্ঠে অবতরণ করে। 

​ম্যাজেলান ,ও নাসা/ যুক্তরাষ্ট্র , নভোযান শুক্র গ্রহের কক্ষপথে ১৯৯০ সালের ১০ই অক্টোবর পৌঁছে। 

ভেনাস এক্সপ্রেস - ESA, ২০০৬ সালের ১১ ই এপ্রিল শুক্র গ্রহের কক্ষপথে পৌছায়।

আকাতসুকি - জাপান, ৭ই ডিসেম্বর ২০১৫। 

IKAROS - জাপান ২০১০ সালের ৮ই ডিসেম্বর শুক্র গ্রহকে অতিক্রম করে যায়। 

Reference:

[1] “Venus - NASA Science.” Available: https://science.nasa.gov/venus/.

[2] “Venus - NASA Science.” Available: https://science.nasa.gov/venus/.

[3] “Mariner 2 - NASA.” Available: https://www.nasa.gov/image-article/mariner-2/.

[4] “The spacecraft.” Available: https://www.esa.int/Science_Exploration/Space_Science/Venus_Express/The_spacecraft.