ইউরোপা  

Europa

ইউরোপা – বৃহস্পতি গ্রহের একটি উপগ্রহ, কিন্তু এটা কোন সাদামাটা বিরান উপগ্রহ নয়।বৃহস্পতি গ্রহের জানামতে ৯৫ টি উপগ্রহ আছে, কিন্তু তাদের মধ্যে ৪ টি উপগ্রহ (আইও, গ্যানিমিড, ক্যালিস্টো ও ইউরোপা)  অনেক আগে থেকেই মানুষের চেনা ছিল, বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলি প্রথম পর্যবেক্ষণ করেন, তাই এদেরকে গ্যালিলিওর চাঁদ ও বলা হয়। তবে ইউরোপা তদের মধ্যে আলাদা ও আকর্ষণীয়। বললে হয়ত ভুল হবে না, সৌরজগতের সবচেয়ে আকর্ষণীয় উপগ্রহ হল এই ইউরোপা। এই মুহর্তে নাসা ও ইসা আলাদা ভাবে দুটি নভোযান প্রেরন করেছে আরও গভীর গবেষণার জন্য। নাসা ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে ইউরোপা ক্লিপার নামে একটি নভোযান পাঠায়, যা ২০৩০ সালে বৃহস্পতি গ্রহের কক্ষপথে পৌঁছাবে এবং ২০৩১ সাল থেকে গবেষণার জন্য তথ্য সংগ্রহ শুরু করবে। আর অন্যদিকে, ইউরোপের মহাকাশ সংস্থা ইসা পাঠিয়েছে জুস JUICE (JUpiter ICy moons Explorer) নামে আরেকটি নভোযান বৃহস্পতি ও তার উপগ্রহের উপর গবেষণার জন্য।  ২০২৩ সালে পাঠানো এই নভোযান ২০৩১ সালে বৃহস্পতি গ্রহ ও তার প্রধান উপগ্রহের উপর বৈজ্ঞানিক গবেষণা চালাবে কয়েক বছর ধরে। এতো আগ্রহের কারন ও উদ্দেশ্য কি ? সহজ ভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, প্রানের সন্ধান । তবে এটা ঠিক পৃথিবীর মত জটিল প্রানের কথা হচ্ছে না, ইউরোপার পরিবেশ কি প্রান ধারনের উপযোগী কিনা সেটাই যাচাই করে দেখা। অনেক আগে থেকেই বিজ্ঞানীদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল ইউরোপা। ধারনা করা হয়,  ইউরোপার রয়েছে লবণাক্ত তরল পানির সাগর, এখানে রাসায়নিক বিক্রিয়া হয়, শক্তির উৎস রয়েছে আর আছে সময়। ইউরোপার বয়স ৪০০ কোটি বছরেরও বেশি মানে সৌরজগৎ ও অন্য গ্রহের সমান। ইউরোপার পৃষ্ঠ বরফে ঢাকা কিন্তু তার নিচে রয়েছে সাগর। বৃহস্পতি গ্রহের শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্র ও তেজস্ক্রিয়ার জন্য ভূপৃষ্ঠে প্রান ধারন অসম্ভব কিন্তু বরফে ঢাকা পৃষ্ঠের নিচে তরল সাগরে প্রান ধারনের অনুকুল পরিবেশ থাকতেও পারে। এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজার জন্যই এই মহাকাশ মিশন।

গালিলিও নভোযান থেকে তোলা ছবিতে ইউরোপা উপগ্রহের পৃষ্ঠ দেখা যাচ্ছে। Credit: NASA

ইউরোপা কি প্রান ধারনের উপযোগী?

কঠিন প্রশ্ন, কিন্তু আমরা জানি প্রান ধারনের জন্য বেশ কিছু উপাদানের দরকার, দরকার অনুকুল পরিবেশ।

১। তরল পানি

২। রাসায়নিক উপাদান

৩। শক্তির উৎস , আর দরকার সময়।

ইউরোপায় রয়েছে তরল পানি, বরফ পৃষ্ঠের নিচে রয়েছে তরল পানির সাগর। রয়েছে বিভিন্ন রাসায়নিক পদার্থ যেমন, কার্বন, হাইড্রোজেন, নাইট্রোজেন, অক্সিজেন, ফসফরাস ও সালফার।

আর ইউরোপার শক্তির উৎস হতে পারে বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়া। পৃথিবীর শক্তির মুল উৎস সূর্য, সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে গাছপালা এই শক্তি সঞ্চয় করে ও পড়ে পড়ে অন্যান্য প্রাণী সেই শক্তি গ্রহন করে। কিন্তু ইউরোপায় সউরজে আলো খুবই কম পৌছায়, তাছাড়া রয়েছে বৃহস্পতি গ্রহে মারাত্মক শক্তিশালী তেজস্ক্রিয়তা, তাই ইউরোপার ভূপৃষ্ঠে প্রান থাকা অসম্ভব কিন্তু পৃষ্ঠের নিচে তরল সাগরে প্রান  থাকার অনুকুল পরিবেশ থাকতেও পারে।

তবে একটা ব্যাপার পরিস্কার করে বলা উচিত, ইউরোপাতে কেউ জটিল প্রানের আশা করছে না, এমনকি সরাসরি প্রান থাকার প্রমান পাওয়া অনেক কঠিন। আর প্রানের সংজ্ঞাটাও বেশ ছোট, এখনো পর্যন্ত শুধুমাত্র পৃথিবীতেই প্রানের অস্তিত্ব পাওয়া গিয়েছে, অন্য কোন গ্রহ বা উপগ্রহে অন্য ধরনের প্রান কি রকম হতে পারে সেটা অনুমান করাও বেশ কঠিন কাজ। তবে, বিজ্ঞানীরা মনে করেন, যদি প্রান ধারনের উপযুক্ত পরিবেশ থাকে এবং পর্যাপ্ত সময় দেওয়া থাকে, তাহলে সেখানে এক সময় প্রান বিকাশ ঘটবে। অনেক অতি আশাবাদী বিজ্ঞানীরা মনে করেন হয়ত ইউরোপার গভীর সমুদ্রে ছোট ব্যাকটেরিয়া থাকতেও পারে, তবে এখনো পর্যন্ত কোন তথ্য প্রমান নেই।   

মহাকাশ মিশন

Pioneer 10 and 11- ডিসেম্বর ১৯৭৩

Voyager 1 and 2 – ১৯৭৯ সাল

Galileo – ১৯৯৫ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত

বর্তমান মিশন

Europa Clipper – ২০২৪ সালে পাঠানো, ২০৩১ সালে বৃহস্পতি গ্রহের কক্ষপথে পৌঁছাবে।

JUICE –  ২০২৩ সালে পাঠানো হয়, এখনো মহাশূন্যে রয়েছে, ২০৩১ সালে বৃহস্পতি গ্রহে পৌঁছাবে।

চিত্রঃ বৃহস্পতি ও তার তিনটি উপগ্রহ, আইও, ইউরোপা এবং গ্যানিমিড।

আবিষ্কারঃ

১৬১০ সালে ইতালির বিখ্যাত বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গালিলি টেলিস্কোপ দিয়ে বৃহস্পতি গ্রহের চারটি উপগ্রহ সনাক্ত করেন। উপগ্রহগুলো হলো, গ্যানিমিড, ক্যালিস্টো, আইও ও ইউরোপা। এইজন্য এই চারটি উপগ্রহকে গ্যালিওর উপগ্রহ বলেও ডাকা হয় অনেক সময়। গ্যালিলিও পর্যবেক্ষণ করেন যে চারটি বস্তু বৃহস্পতি গ্রহকে আবর্তন করছে। তখনকার দিনে প্রচলিত ধারনা ছিল, মহাবিশ্বের সবকিছু পৃথিবীকে কেন্দ্র করে আবর্তন করে। এই আবিস্কার এই ভ্রান্ত ধারনা ভেঙ্গে দেয়। তাই এই উপগ্রহ আবিষ্কারের ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেক।

বৈশিষ্ট্যঃ

আকারে আমাদের চাদের মত, একটু ছোট। ব্যাস ৩১২১ কিমি। ইউরোপার অনেকগুলু আকর্ষণীয় বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যেমন ভূপৃষ্ঠ মসৃণ, তেমন কোন খাদ নেই, সম্পূর্ণ পৃষ্ঠ বরফ দিয়ে আবৃত। ইউরোপার আলবিডো অনেক ০.৬৭ , আলবিডো মানে হল প্রাপ্ত আলোর কতটুকু প্রতিফলিত করে। তার মানে, ৬৭% আলো প্রতিফলিত হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য পৃথিবীর আলবিডো ০.৩ (৩০% ) ও চাদের আলবিডো ০.১২ (১২%)। ইউরোপার বরফ পৃষ্ঠের জন্যই এত বেশি আলবিডো, অধিকাংশ আলো প্রতিফলিত হয়। ইউরোপা একটি অত্যন্ত শীতল একটি উপগ্রহ। নিরক্ষীয় এলাকার তাপমাত্রা -১৬০ ডিগ্রী সেলসিয়াস ও মেরু এলাকা আরও অনেক ঠাণ্ডা, প্রায় -২২০ ডিগ্রী সেলসিয়াস।

ইউরোপা বৃহস্পতি গ্রহ থেকে প্রায় ৬৭১,০০০ কিমি দূর থেকে প্রতি ৩.৫ দিনে একবার আবর্তন করে, বৃহস্পতি গ্রহ সূর্য থেকে ৫.২ AU (1 AU = Distance between sun and earth) দূরে অবস্থিত ও সূর্যের আলো বেশ ক্ষিন, পৃথিবীর প্রাপ্ত আলোর মাত্র ২৫% আলো ইউরোপাতে পৌছাতে পারে।

ইউরোপার রয়েছে বেশ কয়েক স্তর, একদম কেন্দ্রে রয়েছে লৌহ কেন্দ্র, তার উপরে রয়েছে ধাতু বা শিলার ম্যান্টল, ম্যান্টলের উপরে রয়েছে বিশাল লবণাক্ত সাগর, ধারনা করা হয় এই লবণাক্ত সাগরের গভীরতা ৬০ থেকে ১৫০ কিমি। আর সবার উপরের স্তর হচ্ছে পৃষ্ঠ, কিন্তু এটা বরফের পৃষ্ঠ, সম্পূর্ণ উপগ্রহের পৃষ্ঠের বরফে ঢাকা। এত শীতল পরিবেশে বরফ অনেকটা কঠিন শিলা পাথরের মতই কঠিন, ইউরোপার পৃষ্ঠের তাপমাত্রা -১৬০ থেকে -২২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই বরফ পৃষ্ঠের প্রায় ১৫ থেকে ২৫ কিমি পুরু। ইউরোপার পৃষ্ঠ সৌরজগতের সবচেয়ে মসৃণ পৃষ্ঠের উপগ্রহ। অন্য গ্রহ উপগ্রহে যেমন রয়েছে অনেক খাদ, যা শত কোটি বছরের বিভিন্ন উল্কা , গ্রহাণুর আঘাতে সৃষ্ট। কিন্তু এই ধরনের খাদ ইউরোপার পৃষ্ঠে দেখা যায় না। তার মানে, ইউরোপার পৃষ্ঠ হয়ত নতুন ও প্রতিনিয়ত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যায়। ধারনা করা হয়, পৃষ্ঠ হয়ত মাত্র ৪ থেকে ৯ কোটি বছরের পূরানো ( হা, কোটি বছর মহাকালের তুলনায় বেশ নগণ্য)।  গ্যালিলিও নভোযানের ছবিতে দেখা যায়, ইউরোপার পৃষ্ঠে রয়েছে লালচে-বাদামি রঙের ফাটল , এই লালচে-বাদামি রঙের কারন হতে পারে সালফার যৌগ , বরফ। যদিও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না এখনো। ইউরোপার রয়েছে অত্যন্ত পাতলা অক্সিজেনের বায়ুমণ্ডল।

গ্যালিলিও নভোযান ইউরোপা উপগ্রহে বিশেষ ধরনের চৌম্বকক্ষেত্রের সন্ধান পায়। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, এই ধরনের চৌম্বক ক্ষেত্র থাকার কারন হতে পারে পৃষ্ঠের নিচে লবণাক্ত সাগর।

ইউরোপা উপগ্রহের বিভিন্ন স্তর। Credit: France24.com/ Stéphane Koguc, Jonathan Walter, AFP/NASA

[1] “Europa: Facts - NASA Science.” Available: https://science.nasa.gov/jupiter/moons/europa/europa-facts/. [Accessed: Oct. 25, 2024]

[2] “Europa’s Interior May Be Hot Enough to Fuel Seafloor Volcanoes,” NASA’s Europa Clipper. Available: https://europa.nasa.gov/news/32/europas-interior-may-be-hot-enough-to-fuel-seafloor-volcanoes. [Accessed: Oct. 25, 2024]

Published: 28/10/2024