চাঁদের কথা


চাঁদ পৃথিবীর একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহ। পৃথিবীর উপর চাঁদের প্রভাব অনেক। পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তন, জোয়ার - ভাটা এবং পৃথিবীর স্থিতিশীল অক্ষের উপর চাঁদের প্রভাব অনেক। চাঁদ সৌরজগতের পঞ্চম বৃহত্তম উপগ্রহ।

পৃথিবী ছাড়া একমাত্র স্থান/গ্রহ/উপগ্রহ যেখানে মানুষ প্রদার্পন করেছে। এখনো পর্যন্ত ১২ জন নভোচারী চাদের মাটিতে প্রদার্পন করেছেন, সবাই যুক্তরাষ্ট্রের। ১৯৭২ সালের ১১ ই ডিসেম্বর সর্বশেষ নভোচারী চাদের পৃষ্ঠে বিচরণ করেন, তার পর আর কোন মনুষ্যবাহী  চন্দ্রমিশন পরিচালিত হয়নি। তবে নাসা নতুন চন্দ্রমিশন আরটেমিস হাতে নিয়েছে, এই মিসনে নাসা চাদে আবার মনুষ্যবাহী মিশন পরিচালিত করবে।

চাঁদের গঠন

চাঁদকে তিনটি অংশে ভাগ করা যায়, কোর , মেন্টাল এবং ক্রাস্ট।

কোর বা কেন্দ্র

একদম কেন্দ্রে কঠিন লৌহ কেন্দ্র, যার ব্যাসার্থ ২৪০ কিমি। এই স্তরের উপর রয়েছে ৯০ কিমি পুরু তরল লোহার স্তর। কেন্দ্রের উপরের স্তরে রয়েছে ১৫০ কিমি পুরু আংশিক গলিত স্তর।

মেন্টাল

কেন্দ্রের উপরের স্তরে এই স্তর। এই স্তর আংশিক গলিত কেন্দ্রের উপর থেকে শুরু করে ক্রাস্ট পর্যন্ত ব্যাপি। এই স্তর খনিজ সমৃদ্ধ যেমন অলিভাইন ও পাইরক্সিন , এই খনিজের উপাদান মূলত ম্যাগনেসিয়াম , লোহা, সিলিকন ও অক্সিজেন।

ক্রাস্ট বা উপরের পৃষ্ঠস্তর

উপরের স্তরের পুরুত্ত ৭০ কিমি থেকে ১৫০ কিমি । এই স্তরের উপাদান মূলত অক্সিজেন , সিলিকন, ম্যাগনেসিয়াম , আয়রন, ক্যালসিয়াম, অ্যালুমিনিয়াম। এই স্তরে আর অল্প পরিমাণে রয়েছে টাইটানিয়াম, থোরিয়াম, ইউরেনিয়াম, পটাসিয়াম এবং হাইড্রোজেন। চাঁদে একসময় সক্রিয় আগ্নেয়গিরি ছিল, এখন অবশ্য সব সুপ্ত।

​তথ্যসূত্র - ২,১৩

আকার ও দূরত্ব

চাঁদের ব্যাসার্ধ ১৭৩৭.৫ কিমি । পৃথিবী ও চাঁদের গড় দূরত্ব ৩৮৪৪০০ কিমি। চাঁদ আস্তে আস্তে পৃথিবী থেকে দুরে সরে যাচ্ছে , প্রতি বছর চাঁদ প্রায় ১ ইঞ্চি দুরে যাচ্ছে পৃথিবী থেকে।

চাঁদের পৃথিবীকে আবর্তন

পৃথিবী থেকে সব সময় চাঁদের একটি মাত্র দিক দেখতে পাওয়া যায়। চাঁদ নিজের অক্ষে একবার ঘুরতে জোত সময় লাগে, ঠিক একই সময় নেয় পৃথিবীকে আবর্তন করতে। নিজেকে আবর্তন করতে চাঁদের ২৭ দিন লাগে , ঠিক একই সময় লাগে পৃথিবীকে একবার পরিভ্রমণ করতে, কিন্তু যেহেতু পৃথিবী নিজেও নিজের অক্ষপথে ঘুরছে টাই পৃথিবীর সাপেক্ষে এই সময় ২৯ দিন।


ভূ পৃষ্ঠ

চাঁদের বায়ুমণ্ডল অত্যন্ত হাল্কা হওয়ার কারণে চাঁদকে রক্ষ্যা করার মত তেমন কোন উপায় নেই, তাই কোটি কোটি বছর ধরে চাঁদের পৃষ্ঠে ধূমকেতু , উল্কা ইত্যাদি আসড়ে পড়ে এবং এই জন্য চাঁদের পৃষ্ঠে অসংখ্য খাদ দেখতে পাওয়া যায়। দিনের বেলা চাঁদের তাপমাত্রা ১২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠে, রাতের বেলা তাপমাত্রা - ১৭৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত নেমে যায়।

চাদে কি পানি রয়েছে ? বিভিন্ন মিশনের তথ্য প্রমানে এখন নিশ্চিত করে বলা যায়, চাদে পানি আছে। তবে এই পানি বরফ আকারে রয়েছে। LCROSS, LRO , M3/ Chandrayaan-1 ও SOFIA মিশনের তথ্য থেকে চাদে পানির অস্তিত্বের নিশ্চিত প্রমান পাওয়া গিয়েছে।

বায়ুমণ্ডল

চাঁদের বায়ুমণ্ডল অত্যন্ত পাতলা, সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি থেকে রক্ষ্যার কোন উপায় নেই।

বায়ুচাপ - 3 x 10-15 bar ( পৃথিবীর ১ বার )

বায়ুমণ্ডলের উপাদান ( প্রতি ঘন সেন্টিমিটারে কণার পরিমাণ , রাতের বেলা)

হিলিয়াম  Helium 4 (4He) - 40,000

নিওন  Neon 20 (20Ne) - 40,000

হাইড্রোজেন Hydrogen (H2) - 35,000

আর্গন  Argon 40 (40Ar) - 30,000

নিওন Neon 22 (22Ne) - 5,000

আর্গন Argon 36 (36Ar) - 2,000

মিথেন Methane - 1000

অ্যামোনিয়া Ammonia - 1000

কার্বন-ডাই -অক্সাইড  Carbon Dioxide (CO2) - 1000

অন্যান্য উপাদান

Trace Oxygen (O+) অক্সিজেন একক পরমাণু হিসেবে বা চার্জড অক্সিজেনও বলা হয়

Aluminum (Al+)

Silicon (Si+)

Phosphorus (P+),

Sodium (Na+),

Magnesium (Mg+)

 চৌম্বক ক্ষেত্র: চাঁদের খুবই দুর্বল চৌম্বক ক্ষেত্র , পৃথিবীর তুলনায় নগণ্য ।

চাঁদের সৃষ্টি


চাঁদ তৈরি হওয়ার বেশ কিছু তত্ত্ব রয়েছে, তবে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য তত্ত্ব হিসেবে ধরা হয়, ইমপ্যাক্ট থিওরি বা সংঘর্ষ তত্ত্ব।

চাঁদ প্রায় ৪৫০ কোটি বছর আগে সৃষ্টি হয়, সৌরজগত সৃষ্টি হওয়ার ৩-৫ কোটি বছর পরেই চাঁদের সৃষ্টি। আগের পৃথিবী ও মঙ্গল গ্রহ সাদৃশ্য আরেকটি গ্রহের ( থিয়া ) মুখোমুখি সংঘর্ষের ফলে চাঁদ গঠিত হয়। এই তত্ত্বের গ্রহণযোগ্যতার অন্যতম কারণ চাঁদ এবং পৃথিবীর অক্সিজেনের আইসোটোপের অনুপাত সমান, সাধারণ অক্সিজেন O-16, আরও আইসোটোপ যেমন O-17, O-18 (নিওট্রন সংখ্যা ভিন্ন)  . বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে পৃথিবী ও চাঁদের অক্সিজেনের আইসোটোপের অনুপাত সমান।

তথ্যসূত্র - ৮,৫,৬,৭,৮। 

বিভিন্ন অভিযান

১৯৫৮, ১৭ই অগাস্ট

প্রথম চন্দ্র অভিযানের প্রচেষ্টা । যুক্তরাষ্ট্র প্রথম চন্দ্র অভিযানের চেষ্টা চালায়, কিন্তু পাইওনিয়ার-০ মিশন উৎক্ষেপণের মাত্র ৭৭ সেকেন্ড পর দুর্ঘটনায় পতিত হয়।


১৯৫৯ , ২রা জানুয়ারী

পৃথিবীর মুক্তিবেগ পার হওয়া। সোভিয়েত রাশিয়া প্রেরিত লুনা-১ প্রথম মানব সৃষ্ট যান যা পৃথিবীর অভিকর্ষ বলয় থেকে বের হতে সক্ষম হয়, তথাকথিত হেলিও- ছেন্ত্রিক কক্ষপথে পৌঁছে যায়। যদিও লুনা-১ সফল অভিযান হয়নি কিন্তু চন্দ্রঅভিযানের একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

১৯৫৯ , ১৪ই সেপ্টেম্বর

প্রথম মহাকাশযান অবতরণ। রাশিয়া প্রেরিত লুনা-২ প্রথম মহাকাশযান চাঁদের মাটিতে অবতরণ করে।

১৯৫৯, ৭ই অক্টোবর

চাঁদের অপরপাশের চিত্রগ্রহণ। রাশিয়া প্রেরিত লুনা-৩ মহাকাশযান প্রথম চাঁদের অপরপাশের ছবি তুলতে সক্ষম হয়। টাইডাল লকের কারণে চাঁদের এক পাশ সব সময় পৃথিবী থেকে দৃশ্যমান হয়। লুনা-৩ প্রথম চাঁদের অপর পাশে পৌছাতে সক্ষম হয়।

১৯৬৬, ৩রা ফেব্রুয়ারী

প্রথম সফল ও নিরাপদে চাঁদের পৃষ্ঠে অবতরণ। রাশিয়া প্রেরিত লুনা-৯ প্রথম চাঁদের মাটিতে সফল ভাবে অবতরণ করে এবং পৃষ্ঠের ছবি পাঠায়। এই অভিযানে প্রমাণিত হয়, চাঁদের পৃষ্ঠে মহাকাশযান অবতরণ সম্ভব (চাঁদের বালিতে ডুবে যাবে না , অনেকের ধারনা ছিল মহাকাশযান চাঁদের বালিতে ডুবে যাবে)।  

১৯৬৬, ২রা এপ্রিল

চাঁদের কক্ষপথে সফল পরিভ্রমণ। লুনা-১০ (রাশিয়া) প্রথম মহাকাশযান চাঁদের কক্ষপথে আবর্তন করে। মহাকাশযান ( লুনা-১০)  ৫৬  দিনে ৪৬০ বার চাঁদকে পুর্ন আবর্তন করে।

১৯৬৬, ২৩ই অগাস্ট

যুক্তরাষ্ট্রের লুনার অরবিটার -১ চাঁদের কক্ষপথ থেকে পৃথিবীর ছবি তোলে।

১৯৬৭, ১৭ই নভেম্বর

চাঁদের পৃষ্ঠে প্রথম উথখেপন ( Liftoff). যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশযান সারভেয়র -৬ ল্যান্ডার সফল ভাবে চাঁদের মাটি থেকে উথখেপন করে এবং আবার অবতরণ করে। এটি একটি পরীক্ষামূলক মিশন, মিশনের প্রধান লক্ষ্য ছিল চাঁদের মাটি থেকে মহাকাশযানের উৎক্ষেপণের সম্ভাব্যতা যাচাই করা।

১৯৬৮, ২১শে সেপ্টেম্বর

জীবিত প্রাণীসহ মহাকাশযান চাঁদের কক্ষপথ থেকে সফল ভাবে পৃথিবীতে ফিরে আসা। রাশিয়া ( সোভিয়েত ইউনিয়ন ) প্রেরিত জন্দ - ৫ মহাকাশযান ২ই কচ্ছপ ও অন্যান্য প্রাণী বহন করে চাঁদের কক্ষপথে আবর্তন করে এবং সফল ভাবে পৃথিবীতে ফিরে আসে। প্রাণীদের উপর মহাশূন্যে ভ্রমণের প্রভাব পর্যবেক্ষণের জন্য এটি পরীক্ষামূলক অভিযান। এই অভিযানে প্রমাণিত হয়, প্রাণীরা মহাশূন্যে নিরাপদে ভ্রমণে সক্ষম।

১৯৬৯, ২০শে জুলাই

মানুষের চাঁদের মাটিতে প্রদার্পন । নেইল আর্মস্ট্রং প্রথম মানুষ হিসেবে চাঁদের মাটিতে অবতরণ করেন, ১২ জন নভোচারী চাঁদের মাটিতে প্রদার্পন করেছেন।

১৯৬৯, ১৯শে নভেম্বর

দ্বিতীয় মনুষ্যবাহী চন্দ্র-অভিযান । এপোলো -১২ ।

১৯৭০, ১২ই সেপ্টেম্বর

২১শে সেপ্টেম্বর : প্রথম রোবট মহাকাশযান, চাঁদের মাটিতে সফল অবতরণ করে, মাটি খনন করে, মাটি সংগ্রহ করে এবং সফল ভাবে পৃথিবীতে ফিরে আসে।

১৯৭০, ১৭ই নভেম্বর

রাশিয়া প্রেরিত লুনোখদ- ১ (Lunokhod-1) প্রথম রোবট চাকার যান চাঁদের মটিতে চরে বেড়ায়। প্রায় ১১ দিন এই রোবট গাড়ি চাঁদে চালু ছিল।

১৯৭২, ৭ই ডিসেম্বর : এপোলো - ১৭

এপোলো - ১৭ , সর্বশেষ মনুষ্যবাহী চন্দ্র-অভিযান।

২০০৯, ২৪শে সেপ্টেম্বর

চাঁদে পানির অস্তিত্ব । চাঁদের বিভিন্ন খনিজ পদার্থে পানির অণুর অস্তিত্ব পাওয়া যায়।

২০২৪ সাল, ২রা জুনঃ

Chang’e-6 probe, চিন

​তথ্যসূত্র ২,১০ 


তথ্য সূত্র

১। Moon Fact Sheet, NASA, http://nssdc.gsfc.nasa.gov/planetary/factsheet/moonfact.html

২। Earth's Moon: Overview: Our Natural Satellite, NASA, http://solarsystem.nasa.gov/planets/moon

৩। Moon, Wikipedia.org , https://en.wikipedia.org/wiki/Moon

৪। NASA scientist Jen Heldmann describes how the Earth’s moon was formed, NASA, https://sservi.nasa.gov/articles/nasa-scientist-jen-heldmann-describes-how-the-earths-moon-was-formed/

৫। The Moon Forms, BBC, http://www.bbc.co.uk/science/earth/earth_timeline/moon_formed

৬। New theory explains how the moon got there, phys.org, https://phys.org/news/2016-10-theory-moon.html

৭। Moon was produced by a head-on collision between Earth and a forming planet,UCLA,

http://newsroom.ucla.edu/releases/moon-was-produced-by-a-head-on-collision-between-earth-and-a-forming-planet

৮। Western Washington University, https://www.wwu.edu/skywise/moon.html

৯। The Moon, NASA, https://www.nasa.gov/moon

১০। CHRONICLE OF SOVIET-RUSSIAN SPACE PROGRAM,State Space Corporation ROSCOSMOS(Official)  , http://en.roscosmos.ru/174/

১১। Earth’s Moon| In Depth, NASA, http://solarsystem.nasa.gov/planets/moon/indepth

১২। Picture , Internal Structure of the Moon, Wikimedia,  https://commons.wikimedia.org/wiki/File:Internal_Structure_of_the_Moon.JPG

১৩। https://en.wikipedia.org/wiki/Internal_structure_of_the_Moon