আইও (Io)

জীবন্ত আগ্নেয়গিরিপূর্ণ একটি সতেজ জীবন্ত উপগ্রহ, বৃহস্পতি গ্রহের উপগ্রহ।  আইও বৃহস্পতি গ্রহের একটি অন্যতম উপগ্রহ। আইও ১৬১০ সালে ইতালির বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলি আবিষ্কার করেন। গ্যালিলি ৪ টি বৃহস্পতি উপগ্রহ সনাক্ত করেন, তার সম্মানে এই চারটি উপগ্রহকে গ্যালিলির উপগ্রহও বলা হয়, বাকি তিনটি হলো গ্যানিমিড , ক্যালিস্টো ও ইউরোপা। গ্যালিলির এই আবিষ্কারের প্রভাব অনেক, তার আগে অনেকেই বিশ্বাস করতো সবকিছু পৃথিবীকে কেন্দ্র করে আবর্তন করে, কিন্তু এই পর্যবেক্ষণ ও আবিষ্কারের পর জানা গেল গ্রহগুলো আসলে সূর্যকে করে আবর্তন করে।

আইও হল পৃথিবী ছাড়া সৌরজগতের একমাত্র স্থান যেখানে এখনো জীবন্ত আগ্নেয়গিরি রয়েছে, ধারনা করা হয় ৪০০ এরও বেশি সক্রিয় আগ্নেয়গিরি আছে আইও উপগ্রহতে।

আইওকে বলা হয় জীবন্ত, সক্রিয় উপগ্রহ যদিও সেটা ভূগোলবিদদের ভাষা, আসলে আইও একটি জলন্ত নরক, এখানে প্রান ধারনের সম্ভবনা খুবই কম, নেই বললেই চলে। এখানে রয়েছে সৌরজগতের সবচেয়ে বেশি আগ্নেয়গিরি, আছে লাভার হ্রদ, কোন বায়ুমণ্ডল নেই। আইও তার গ্রহ বৃহস্পতির বেশ কাছে, সেজন্য আইওকে বৃহস্পতি গ্রহের অত্যন্ত শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্র ও ক্ষতিকারক তেজস্ক্রিয় বিকিরনের মুখোমুখি হতে হয়। এতকিছুর পরও আইও আসলে একটি জীবন্ত উপগ্রহ, গ্রহ বিজ্ঞানীদের ভাষায় সক্রিয় স্থান। এখানে সবসময় বিভিন্ন ভৌগলিক কার্যকলাপ হচ্ছে, যেমন আগ্নেয়গিরি, অন্য উপগ্রহের মহাকর্ষ বলের প্রভাব, এই উপগ্রহের পৃষ্ঠে তেমন কোন খাদ নেই তারমানে আইওর ভূপৃষ্ঠ পরিবর্তনশীল।

আইও বৃহস্পতির সবচেয়ে কাছের গ্রহ ( চারটি বড় উপগ্রহের মধ্যে), বৃহস্পতি গ্রহের পৃষ্ঠ থেকে ৩৫০,০০০ কিমি দূর থেকে গ্রহকে প্রদক্ষিন করে, আইও প্রতি ১.৮ দিনে বা ৪২.৫ ঘণ্টায় বৃহস্পতি গ্রহকে একবার আবর্তন করে।

আকার

আইও আকারে আমাদের চাঁদ থেকে সমান্য বড়, ব্যাসার্ধ ১৮২১ কিমি। সৌরজগতের চতুর্থ বৃহত্তম উপগ্রহ।  

কক্ষপথ

আইও প্রায় ১.৮ দিনে বৃহস্পতি গ্রহকে একবার প্রদক্ষিন করে। বৃহস্পতি গ্রহের চারটি উপগ্রহ একটি অদ্ভুত ছন্দে আবর্তন করে, যেমন গ্যানিমিড যখন একবার আবর্তন করে, তখন সেই একই সময়ে ইউরোপা দুইবার বৃহস্পতিকে আবর্তন করে এবং আইও ঠিক চারবার আবর্তন সম্পন্ন করে। এই ধরনের ছন্দময় আবর্তনকে ল্যাপ্লাস আনুরণন (Laplace resonance) বলে। আইও তার অন্য উপগ্রহ থেকে সবসময় মহাকর্ষ বলের প্রভাবে থাকে, তাছাড়া বৃহস্পতি গ্রহের অত্যন্ত শক্তিশালী মহাকর্ষ বলয়ের প্রভাবের কারনে উপগ্রহ প্রতিনিয়ত চাপের কারনে সম্প্রসারণ এবং সংকোচনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। এই প্রতিনিয়ত সম্প্রসারণ এবং সংকোচন আইওর অস্বাভাবিক আগ্নেয়গিরির সক্রিয়তার কারন। আইও বেশ কাছের উপগ্রহ, বৃহস্পতি গ্রহের রয়েছে অত্যন্ত শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্র ও আইও ঠিক এই চৌম্বক ক্ষেত্রের ভিতর দিয়েই আবর্তন করে চলছে। চৌম্বক ক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে চলার জন্য আইও অনেকটা ইলেক্ট্রিক জেনারেটরের মত কাজ করে। আইও প্রায় ৪ লক্ষ ভোল্ট ভোল্টেজ ও ৩০ লক্ষ অ্যাম্পিয়ার কারেন্ট তৈরি করে এবং এই কারেন্ট চৌম্বক ক্ষেত্রের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বৃহস্পতি গ্রহে ফিরে যায় এবং বৃহস্পতি গ্রহে বজ্রপাত তৈরি করে।

চিত্রঃ ২০০৭ সালে New Horizon নভোযান আইও উপগ্রহ থেকে ২৪ লক্ষ কিমি দূর থেকে এই ছবি তুলে, ছবিতে আইওর উত্তর মেরুর কাছে একটি সক্রিয় আগ্নেয়গিরি দেখা যাচ্ছে।  Credit: NASA/Johns Hopkins University Applied Physics Laboratory/Southwest Research Institute

মহাকাশ মিশন

এখনও পর্যন্ত বেশ কিছু মহাকাশযান বৃহস্পতি গ্রহ ও উপগ্রহ এলাকায় পাঠানো হয়েছে।

Pioneer 10 – ১৯৭৩ সালে ফ্লাই-বাই করে

Pioneer 11 – ১৯৭৪ সালে আইও উপগ্রহ ফ্লাই-বাই করে

Voyager 1 & 2 – ১৯৭৯ সালে আইও উপগ্রহের পাশ দিয়ে উরে যায় ও তথ্য সংগ্রহ করে

Galileo – ১৯৯৫ সালে গ্যালিলিও নভোযান বৃহস্পতি ও তার উপগ্রহ মন্দলে পৌছায়।

New Horizon: এই মিশন প্লুটো অভিমুখে যাওয়ার পথে ২০০৭ সালে আইও ও বৃহস্পতি গ্রহের পাশ দিয়ে চলে যায় এবং যাবার পথে কিন্তু ছবি ও তথ্য সংগ্রহ করে।

ক্যাসিনিঃ ক্যাসিনি শনি গ্রহের অভিমুখে যাত্রাপথে অল্প সময় আইও উপগ্রহ থেকে তথ্য সংগ্রহ করে।

জুনোঃ ২০১৬ সালে জুনো নভোযান বৃহস্পতি গ্রহের কক্ষপথে পৌছায়, এটি একটি সফল মিশন, এই মিশন বৃহস্পতি গ্রহ ও আইও-সহ উপগ্রহ থেকে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করে।

ভবিষ্যৎ মহাকাশ মিশনঃ

২০৩১ সালে ইউরোপের পাঠানো জুস  Jupiter Icy Moon Explorer (JUICE) নভোযান বৃহস্পতি গ্রহের কক্ষপথে পৌঁছাবে।

আর ২০২৪ সালে, নাসার নভোযান ইউরোপা ক্লিপার পাঠানোর কথা রয়েছে এবং ২০৩০ সালে বৃহস্পতি গ্রহের কক্ষপথে পৌঁছাবে।

চিত্রঃ জুনো নভোযান থেকে তোলা আইওর ভূপৃষ্ঠের ছবি। Credit: NASA.

চিত্রঃ গ্যানিমিড, ইউরোপা ও আইও উপগ্রহের ল্যাপ্লাস আনুরণন (Laplace resonance) কক্ষপথ, গ্যানিমিড যখন একবার বৃহস্পতিকে আবর্তন করে, তখন সেই একই সময়ে ইউরোপা দুইবার এবং আইও ঠিক চারবার আবর্তন সম্পন্ন করে। । Credit: Image collected from Wikipedia.

ভূপৃষ্ঠ ও পরিবেশ

আগেই বলা হয়েছে, আইও সৌরজগতের সবচেয়ে সক্রিয় আগ্নেওগিরির স্থান। কয়েকশত সক্রিয় আগ্নেয়গিরি রয়েছে, ভূপৃষ্ঠ সালফার ও সালফার ডাই-অক্সাইড দিয়ে আবৃত। সক্রিয় আগ্নেওগিরির অগ্নুপাত দূর থেকে স্যাটেলাইট দিয়েও দেখা সম্ভব, এই আগ্নেয়গিরির লাভা ভুমি থেকে কয়েকশত কিমি উপরে নির্গত করতে পারে।  বিভিন্ন নভোযান থেকে আগ্নেওগিরির আগ্নতপাতের ছবি পাওয়া গিয়েছে। আইওস বায়ুমণ্ডল অত্যন্ত পাতলা এবং বায়ুমণ্ডলের প্রায় ৯০ ভাগ হচ্ছে সালফার-ডাই-অক্সাইড। পৃথিবীর মত আইওতে ও জোয়ার ভাটার প্রভাব দেখা যায়, বৃহস্পতি গ্রহের শক্তিশালী মহাকর্ষ বলের প্রভাবে উপগ্রহ আইও ১০০ মিটার পর্যন্ত সংকোচন ও সম্প্রসারণ হতে পারে, প্রসঙ্গত উল্লেখ্য এই জোয়ারভাটার প্রভাব হয় কঠিন ভূপৃষ্ঠের উপর। আইওর অভ্যন্তরীণ গঠন সম্পর্কে নিশ্চিত করে বলা কঠিন তবে কেন্দ্র লোহার। বৃহস্পতি গ্রহ প্রতি সেকেন্ডে আইও থেকে প্রায় ১ টন উপাদান শুষে নেয় শক্তিশালী চৌম্বক বলের জন্য এবং এই উপাদানগুলো বৃহস্পতি গ্রহের শক্তিশালী চৌম্বকক্ষেত্রের প্রভাবে আয়নিত হয়ে প্লাজমা মেঘ তৈরি করে যা প্লাজমা টরাস নামে পরিচিত। এই আয়নের কিছু অংশ চৌম্বক লাইনের মাধ্যমে বৃহস্পতি গ্রহে ফিরে যায় এবং চমৎকার মেরুজ্যোতি সৃষ্টি করে।

২০০৭ সালে New Horizon নভোযান থেকে তোলা বৃহস্পতি গ্রহ ও আইও উপগ্রহের ছবি।  Credit: NASA/JHUAPL.

তথ্যসুত্রঃ

Published: 19/10/2024

[1] “Io - NASA Science.” Available: https://science.nasa.gov/jupiter/moons/io/. [Accessed: Oct. 12, 2024]

[2] “Io: Facts - NASA Science.” Available: https://science.nasa.gov/jupiter/moons/io/facts/. [Accessed: Oct. 12, 2024]

[3] “Jupiter’s Moon Io has been Volcanically Active for Billions of Years,” California Institute of Technology, Apr. 18, 2024. Available: https://www.caltech.edu/about/news/jupiters-moon-io-has-been-volcanically-active-for-billions-of-years. [Accessed: Oct. 12, 2024]

[4] “Io in Jupiter’s magnetic field.” Available: https://www.esa.int/ESA_Multimedia/Images/2023/01/Io_in_Jupiter_s_magnetic_field. [Accessed: Oct. 12, 2024]

[5] "Io (Moon)." Wikipedia, Wikimedia Foundation, 10 Oct. 2024, en.wikipedia.org/wiki/Io_(moon). Accessed 12 Oct. 2024.