ট্রাইটন (Triton)

নেপচুনের হিমশীতল চাঁদ

ট্রাইটন – নেপচুনের একটি রহস্যময় ও আকর্ষণীয় উপগ্রহ। সৌরজগতের এক প্রান্তে পড়ে থাকা একটি উপগ্রহ প্রথম আবিষ্কার করেন ব্রিটিশ সৌখিন জ্যোতির্বিজ্ঞানী উইলিয়াম ল্যাসেল (William Lassell) । নেপচুন আবিষ্কারের মাত্র ১৭ দিন পর ১৮৪৬ সালের ১০ ই অক্টোবর টেলিস্কোপের মাধ্যমে ট্রাইটন আবিষ্কার করেন। ট্রাইটন কিছুটা অদ্ভুত, যেমন এটি উল্টা দিকে নিজের গ্রহ নেপচুনকে আবর্তন করে, এটা সৌরজগতের সবচেয়ে শীতল স্থান।

সৃষ্টি

ট্রাইটন কিভাবে গঠিত হয় ?  সেটা নিশ্চিত করে বলা কঠিন, কিন্তু এখন ধারনা করা হয়, ট্রাইটন আসলে প্রথমে নেপচুনের উপগ্রহ ছিল না। ট্রাইটন হয়ত প্রথমে প্লুটোর কাছাকাছি এলাকায় সৃষ্টি হওয়া ছোট বামন গ্রহ। কোন কারনে সেটা নেপচুন গ্রহের আসে পাশে আসার পর মহাকর্ষ বলের প্রভাবে আটকে পড়ে, ঠিক এই কারনে ট্রাইটন নেপচুনকে কেন্দ্র করে উল্টা দিকে আবর্তন করে । নেপচুন নিজের অক্ষে যেদিকে ঘুরে বাকি উপগ্রহগুলো সেইদিকে আবর্তন করে , কারন সেগুলো প্রায় কাছাকাছি সময়ে সৃষ্টি হয়েছিল । ট্রাইটন কাইপার বেল্ট এলাকায় সৃষ্টি হতে পারে।  তাছাড়া ট্রাইটন ও প্লুটোর রাসায়নিক উপাদানেও মিল রয়েছে যেমন, মিথেন , অ্যামোনিয়া সূর্যের অতিবেগুনী রশ্মির প্রভাবে থলিন্স তৈরি করে এবং এটি লাল রঙের হয়। প্লুটো ও ট্রাইটনের পৃষ্ঠের লাল রঙের কারন এই থলিন্স।

ভূপৃষ্ঠ

আগেই বলা হয়েছে ট্রাইটানে রয়েছে ৩০-৪০% ভাগ বরফ এবং বাকি অংশ শিলা, ধাতু নয়ে গঠিত। ট্রাইটানের ভূপৃষ্ঠ পরিবর্তনশীল এবং সক্রিয় , ধারনা করা হয় ভূপৃষ্ঠ মাত্র ১০ কোটি বছরের মত হবে। ভূপৃষ্ঠে রয়েছে নাইট্রোজেনের বরফ, আরও রয়েছে পানির বরফ, কিছু কার্বন-মনো-অক্সাইড। ট্রাইটানের ভূপৃষ্ঠ পৃথিবীর প্রায় ৪.৫% ভাগ। এই উপগ্রহের আলবেডো albedo প্রায় ৬০-৯৫%, যা সাধারন নয়, যেমন পৃথিবীর প্রায় ৩০% ও চাদের ১১%। আলবেডো কি? আলবেডো হল, একটি গ্রহ বা উপগ্রহ তার পাওয়া তাপ বা শক্তির কতটুকু প্রতিফলিত করে ফেরত দেয়।   যেমন, পৃথিবীর আলবেডো ৩০%, মানে হলো, পৃথিবী সূর্য থেকে যা তাপ সংগ্রহ করে তার প্রায় ৩০ ভাগ ফিরিয়ে দেয়। ট্রাইটনের বেলায় দেখা যায়, ট্রাইটান প্রায় অধিকাংশ তাপ ফিরিয়ে দেয়, এইজন্য ট্রাইটন সৌরজগতের সবচেয়ে শীতল স্থান, তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে -২৩৫ ডিগ্রী। ১৯৮৯ সালের ভয়েজার-২ থেকে দেখা যায়, ট্রাইটনের ভূপৃষ্ঠ থেকে নাইট্রোজেন বা পানি নির্গত হতে দেখা যায়, অনেকটা পৃথিবীর গ্যাসিয়ারের মত।

কক্ষপথ

ট্রাইটন নেপচুন থেকে গড়ে প্রায় ৩৮৪,০০০ কিমি দূর থেকে প্রায় প্রতি ৬ দিনে (৫.৮৭৭ দিন) একবার প্রদক্ষিন করে। আগেও বলা হয়েছে ট্রাইটন নেপচুনকে উল্টা দিকে প্রদক্ষিন করে, তার মানে সাধারনত একটি গ্রহের উপরগ্রহগুলু তার নিজের গ্রহের অক্ষের আবর্তনের দিকেই প্রদক্ষিন করে ( যদিও কিছু ব্যাতিক্রম রয়েছে)। পৃথিবীর চাদের মত ট্রাইটন নিজের গ্রহের সাথে টাইডাল-লকড, মানে আমরা যেমন সবসময় চাদের শুধু একপাশ দেখতে পাই পৃথিবী থেকে ঠিক তেমনি নেপচুন থেকে দেখলে ট্রাইটনের শুধু একপাশ দেখা যেত। আজ থেকে প্রায় ৩৬০ কোটি বছর পর ট্রাইটন নেপচুনের খুব কাছে চলে আসবে , হয়ত সরাসরি নেপচুনের সাথে সংঘাত ঘটবে অথবা ভেঙ্গে ছোট ছোট টুকরা হয়ে নেচুনের বলয় হিসেবে থেকে যাবে।

বায়ুমণ্ডল

ট্রাইটনের রয়েছে পাতলা বায়ুমণ্ডল, বায়ুমণ্ডলের চাপ ৪০ থেকে ৬৫ মাইক্রো-বার যা পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের চাপের চেয়ে ২০,০০০ গুন কম, যদিও ১৯৮৯ সালের ভয়েজার-২ মহাকাশযান বায়ুর চাপ পরিমাপ করেছিল ১৪ মাইক্রো-বার। ট্রাইটনের বায়ুমণ্ডলের মুল উপাদান নাইট্রোজেন , তাছাড়া অল্প পরিমানে রয়েছে কার্বন মনোক্সাইড ও মিথেন। বায়ুমণ্ডলের প্রথম ৮ কিমি পর্যন্ত রয়েছে ট্রোপোস্ফিয়ার (Troposphere) তারপর প্রায় ৯৫০ কিমি পর্যন্ত এলাকা হল থার্মোস্ফিয়ার। ট্রোপোস্ফিয়ার হলো আবহাওয়া স্তর, ট্রাইটনের এই অংশে রয়েছে হাইড্রোকার্বন ও নাইট্রোজেনের মেঘ, এইজন্য ট্রাইটনের আকাশ কুয়াশা ভরা থাকবে।

মহাকাশ অভিযান

১৯৮৯ সালে ভয়েজার-২ ট্রাইটনের ৪০,০০০ কিমি দূর থেকে তথ্য সংগ্রহ করে, ভয়েজার-২ এখনো পর্যন্ত একমাত্র সরাসরি মিশন। তারপর আর কোন মিশন পরিচালিত হয়নি এইদিকে।  সৌরজগতের একপ্রান্তে পড়ে থাকা এই উপগ্রহে মিশন পরিচালনা বেশ জটিল ও ব্যায়বহুল, তাছাড়া বিজ্ঞানীরা হয়ত অন্য গ্রহ উপগ্রহ নিয়ে বেশি ব্যস্ত, যেমন মঙ্গল, বৃহস্পতি, শনি ও তাদের উপগ্রহ যেমন টাইটান, ইঊরোপা, ক্যালিস্টো ইত্যাদি। ট্রাইটন সম্পর্কে ভয়েজার-২ থেকে সংগৃহীত তথ্য ছাড়াও টেলিস্কোপ এর মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করা হয়।

তথ্যসুত্রঃ

প্রকাশকালঃ ২৩সে সেপ্টেম্বর ২০২৪

[1] “Neptune moons: facts - nasa science.” Available: https://science.nasa.gov/neptune/neptune-moons/neptune-moon-facts/. [Accessed: Sep. 19, 2024]

[2] “Pluto and the largest moon of Neptune might be siblings,” New Scientist. Available: https://www.newscientist.com/article/2436032-pluto-and-the-largest-moon-of-neptune-might-be-siblings/. [Accessed: Sep. 19, 2024]

[3] “Triton | Facts & Composition | Britannica,” Aug. 08, 2024. Available: https://www.britannica.com/place/Triton-astronomy. [Accessed: Sep. 19, 2024]

[4] “Triton Moon Regenerating Surface - NASA Science.” Available: https://science.nasa.gov/missions/voyager-program/triton-moon-regenerating-surface/. [Accessed: Sep. 19, 2024]

[5] “Albedo and Climate | Center for Science Education.” Available: https://scied.ucar.edu/learning-zone/how-climate-works/albedo-and-climate#:~:text=Above%20the%20Earth%20surface%2C%20clouds,is%20reflected%20out%20to%20space. [Accessed: Sep. 21, 2024]

[6] information@eso.org, “Triton’s Summer Sky of Methane and Carbon Monoxide,” www.eso.org. Available: https://www.eso.org/public/news/eso1015/. [Accessed: Sep. 21, 2024]

[7] Image Credit: NASA/JPL, taken from Veyager-2 spacecraft