কৃষ্ণ বিবর
বিশাল এই মহাবিশ্বে আমাদের অবস্থান কোথায় ? অর্থাৎ এই পৃথিবী নামক গ্রহটি মহাবিশ্বের কোথায় অবস্থিত ? এর উত্তর খোঁজা শুরু হয়েছে অনেক পূর্ব থেকেই। কিন্তু শেষ পর্যন্ত— দেখা যাচ্ছে এই বিশাল মহাবিশ্বে পৃথিবী নামক গ্রহ খুঁজে বের করা সম্ভব নয়। কেননা পৃথিবী বিশাল এই মহাবিশ্বের কেন্দ্রে অবস্থিত নয়। মহাবিশ্বেকে বুঝার জন্যে বা গবেষণার জন্যে আমরা পৃথিবীকে কেন্দ্র হিসেবে কল্পনা করি। পৃথিবীকে কেন্দ্র ধরেই আমাদের থেকে দূরে অবস্থিত সকল গ্রহ, নক্ষত্র, গ্যালাক্সি ইত্যাদির দূরত্ব নির্ধারণ করে থাকি।
বৃহৎ বিস্ফোরণ মহাবিশ্বের আরম্ভের অনন্যতা অনুসারে এই বিশাল মহাবিশ্ব সৃষ্টি হয়েছে একটি বিস্ফোরণের মাধ্যমে যাকে বলা হয় বিগ ব্যাং(Big Bang) । যার বয়স প্রায় বার থেকে চৌদ্দ বিলিয়ন বছর (১৪*১০^৯ = ১৪০০০০০০০০০ = ১৪ টাইমস ১০ টু পাওয়ার ৯ বছর )। মহা বিস্ফোরণ থেকে সৃষ্টি প্রায় দশ হাজার কোটি গ্যালক্সি নিয়ে মহাবিশ্বের বর্তমান অবস্থান । এসব গ্যালাক্সি আবার হাজার-হাজার, লক্ষ-লক্ষ, কোটি-কোটি নক্ষত্র , ধূমকেতু, গ্যাস, বিভিন্ন ধরনের পদার্থ ইত্যাদির সমন্বয়ে গঠিত । বিশাল এই গ্যালাক্সি মালার মাঝে অবস্থিত একটি গ্যালাক্সি হল মিল্কিওয়ে বা আকাশ গঙ্গা। যেটাকে বলা হয়ে থাকে আমাদের গ্যালাক্সি । ধারণা করা হয় এই মিল্কিওয়ে গ্যালক্সিতে প্রায় বিশ হাজার কোটি নক্ষত্র রয়েছে । এই বিশ হাজার কোটি নক্ষত্রের মধ্যে একটি হল সূর্য । যাকে কেন্দ্র করে আমাদের পৃথিবী নামক গ্রহ বৃত্তাকার পথে ঘুরছে আর আমরা বেঁচে আছি এই পৃথিবীতে, বেঁচে আছে পৃথিবীর প্রাণীকূল এবং উদ্ভিদকূল ।
প্রতিটি গ্যালাক্সির প্রতিটি নক্ষত্র তাদের নিজস্ব আলোয় আলোকিত । এসব নক্ষত্রের আবার কোনটার আলো রঙিন, কোনটার রয়েছে বিচিত্র বর্ণলী, কোনটার ভর বেশী আবার কোনটার ভর কম, কোন কোন নক্ষত্র আমাদের কাছ থেকে অনেক দূরে আবার কোনটা আমাদের অনেক কাছে, বিভিন্ন নক্ষত্রের ভরের উপর নির্ভর করে রয়েছে বিভিন্ন বয়সের নক্ষত্র। দূরে অবস্থিত এসব নক্ষত্রের দৃশ্যমান আলো দেখে আমরা মনে করি নক্ষত্রগুলি অর্থাৎ তারাগুলি জ্বলছে-নিভছে । তারাগুলি জ্বলছে-নিভছে মনে করার কারণ এগুলো স্থির নয় । আসলে যেগুলো জ্বলছে-নিভছে বলে মনে হয় সেগুলো তারা বা নক্ষত্র আর যেগুলো স্থির বলে মনে হয় সেগুলো গ্রহ বা উপগ্রহ।
আমাদের বিশাল এই মহাবিশ্ব সত্যিই এত বিশাল যে এর শেষ সীমানায় আমরা কখনো পৌছাতে পারবনা। বিশালতার কারণেই হোক আর যে কারণেই হোক অসংখ্য নক্ষত্রের উপস্থিতি রয়েছে এই মহাবিশ্বে। তাছাড়া মহাবিশ্বে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন তারার জন্ম হচ্ছে। সুতরাং তারার সঠিক হিসাব পাওয়া সত্যিই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তবে সকল বিজ্ঞানীই তারাগুলোকে ফুটবলের মতো গোলক বলে ধারণা করেন।
এখন প্রশ্ন হল এই তারা গুলো কী ? কী উপায়ে তৈরী হয় ? এর শেষই বা কোথায়? এগুলোর ভেতরের কার্যাবলী কী? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজে পেলেই আমাদের কাঙ্ক্ষিত উত্তর খুঁজে পাব।
আমাদের কাঙ্ক্ষিত প্রশ্নটি হল- "ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণ বিবর "
ব্ল্যাক শব্দের অর্থ কালো বা কৃষ্ণ আর হোল শব্দের অর্থ গর্ত বা বিবর। তাহলে সম্পূর্ণ অর্থ দাঁড়ায় কালো বিবর বা কৃষ্ণ বিবর। আমরা যদি মহাবিশ্বের অস্তিত্ব, প্রকৃতি, গঠন, কার্যকারিতা ইত্যাদি আলোচনা করি তাহলে এই কৃষ্ণ বিবরের নাম অবশ্যই চলে আসবে। জ্যোতির্বিজ্ঞানের তত্ত্ব, সূত্র, গবেষণা ইত্যাদি থেকে এটাই প্রতিয়মান হয় যে ব্ল্যাক হোল হল এমন এক বিবর বা গহ্বর যেখানে আয়তন অতি ক্ষুদ্র কিন্তু এর ভর অত্যন্ত বেশী। অতি ক্ষুদ্র আয়তনে ভর অনেক বেশী হওয়ার কারণে এর মহাকর্ষীয় বল এত বেশী হয় যে সেখান থেকে বা কৃষ্ণ বিবর থেকে কোন প্রকার বস্তু পলায়ন করতে পারেনা। অর্থাৎ কৃষ্ণ বিবর তার ভেতরের সব বস্তুকে তার নিজের দিকে টেনে রাখে। কোন মহাকাশযান পড়লেও সেখান থেকে আর বেরিয়ে আসতে পারেনা । অর্থাৎ ব্ল্যাক হোলের সীমানায় কোনোকিছু পড়ে গেলে সেখান থেকে ফিরে আসা অসম্ভব । ব্ল্যাক হোলের মধ্যাকর্ষণ শক্তি এতই প্রবল যে সেখান থেকে মহাকাশযান বা বস্তু বেরিয়ে আসাতো দূরের কথা, এমনকি তাড়িতচৌম্বক বিকিরণ (যেমন: আলো) পর্যন্ত বেরিয়ে আসতে পারেনা। যদিও মহাকর্ষীয় বলকে সবচেয়ে দুর্বল বল হিসেবে গণ্য করা হয়, কিন্তু কৃষ্ণ বিবরের মাঝে মহাকর্ষীয় বলের মান এত বেশি হয়ে যায় যে এটি মহাবিশ্বের অন্য সকল বলকে অতিক্রম করে। ফলস্বরূপ কৃষ্ণ বিবরের মধ্যে পতিত কোন বস্তুই আর বেরিয়ে আসতে পারেনা।
ব্ল্যাক হোলের মধ্যে যদি কোনো মানুষ পড়ে তাহলে তাঁর মাথা থেকে পা এই সামান্য ব্যাবধানের মধ্যে এত বেশি মধ্যকর্ষণ শক্তি কাজ করবে যার কারণে মুহূর্তের মধ্যে তাকে ছিড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলবে । তাঁর অবস্থা হবে ছেড়া ছেড়া সেমাইয়ের টুকরোর মত । এই ব্ল্যাক হোলকেই মহাকাশের দানব বলে আখ্যায়িত করা হয় ।
কৃষ্ণ বিবর বা ব্ল্যাক হোল কী বা সেটা কিভাবে তৈরী হয় তা জানতে হলে প্রথমে জানতে হবে তারকার জীবন চক্র অর্থাৎ তারকা কি উপায়ে তৈরী হয়?
বিভিন্ন রঙের উপর ভিত্তিকরে নক্ষত্র চার ভাগে ভাগ করা যায়। যথাঃ-
১. হলুদ প্রধান সারি
২. কমলা প্রধান সারি
৩. সাদাপ্রধান সারি
৪. নীল প্রধান সারি
আবার তারার অবস্থার উপর ভিত্তি করে আরো কয়েক ভাগে ভাগ করা যায়। যেমনঃ-
১. লোহিত বামন
২. শ্বেতবামন
৩. লোহিত দানব
৪. শ্বেত দানব
৫. হলুদ দানব
৬. নীল দানব
প্রত্যেকটি তারাই আমাদের এই সুন্দর পৃথিবী থেকে বহু দূরে। এসব তারার কোনটির আলো অনেক বছর পর পৃথিবীতে এসে পৌছেছে। আবার কোন তারার আলো এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে এসে পৌছায়নি। কয়েক বছর থেকে কয়েক লক্ষ বছর লাগতে পারে এসব তারার আলো পৃথিবীতে পৌছাতে । আবার এমন ও তারার আলো দেখছি যেগুলো অনেক আগেই ধ্বংস হয়ে গেছে।
এসব নক্ষত্র দেখতে ছোট-বড়, গোলাকার, ত্রিভুজাকার যাই মনে হোক না কেন এদের ভিতরের কার্যকলাপ সম্পূর্ণ রাসায়নিক বিষয়। নক্ষত্র উৎপন্ন হয় নীহারিকা থেকে। এসব নীহারিকা আবার হাইড্রোজেন গ্যাস ও ধূলিকণার বিশাল ভান্ডার। এই হাইড্রোজেন গ্যাসই হচ্ছে নক্ষত্রের গঠন রহস্যর মূল উপাদান। যখন বৃহৎ পরিমান হাইড্রোজেন গ্যাস নিজস্ব মহাকর্ষীয় আকর্ষণের চাপে নিজের উপরেই চুপসে যেতে থাকে তখই সৃষ্টি হয় একটি তারকার। তারকাটি ধীরে ধীরে সঙ্কুচিত হতে থাকে। সঙ্কুচিত হবার সঙ্গে সঙ্গে পরমাণু গুলি খুব নিকটে আসতে শুরু করে। ধীরে ধীরে পরমাণু গুলি এত বেশি ঘন হয় এবং এত দ্রুতিতে পারষ্পরিক সংঘর্ষ হতে থাকে, ফলে বায়ু উত্তপ্ত হয়। এমতাবস্থায় চাপ খুব প্রবল থাকে। শেষ পর্যন্ত বায়ু এত বেশী উত্তপ্ত হয় যে, হাইড্রোজেন গ্যাসের সংঘষের্র ফলে পরমাণু গুলি দূরে ছিটকে যাওয়ার কথা। কিন্তু দূরে ছিটকে না গিয়ে সংযুক্ত হয়ে হিলিয়াম গ্যাসে পরিণত হয়। এই প্রক্রিয়াটিকে আমরা একটি নিয়ন্ত্রিত হাইড্রোজেন বোমার বিস্ফোরণের মত কল্পনা করতে পারি। হাইড্রোজেন বোমা বিস্ফোরিত হলে যে রকম তাপ নিগর্ত হয় ঠিক তদ্রুপ হিলিয়াম পরমাণু সৃষ্টির ফলে বিপুল পরিমাণে তাপ নির্গত হয়। আর এই জন্যই তারকাটি আলোক বিকিরণ করে। এই বাড়তি উত্তাপ বায়ুর চাপকে ধীরে ধীরে আরো বাড়িয়ে তোলে। যখন বায়ুর চাপ এবং মহকর্ষীর আকর্ষণ প্রায় সমান হয়ে যায় তখনই বায়ুর সংকোচন বন্ধ হয়। পারমাণবিক প্রক্রিয়া থেকে উদ্ভূত তাপ এবং মহাকর্ষীয় আকর্ষণের ভারসাম্যের ফলে তারকাগুলি বহুকাল পর্যন্ত সুস্থিত থাকে। শেষ পর্যন্ত কিন্তু তারকাটির হাইড্রোজেন এবং অন্যান্য জ্বালানি ফুরিয়েও যায়। এখানে একটি ব্যাপার ঘটে যেটা হল- শুরুর পর্যায়ে তারকাটির জ্বালানী যত বেশী থাকে ফুরিয়ে যায় তত তাড়াতাড়ি। এর কারণ তারকার ভর যত বেশী হয় মহাকর্ষীয় আকর্ষণের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষার জন্য তারকাটিকে তত বেশী উত্তপ্ত হতে হয়। (এখানে সংক্ষেপে বলে রাখা দরকার যে মধ্যাকর্ষন বলের সাথে ভরের একটা সম্পর্ক রয়েছে আর তা হল- F = Gm1m2/r^2, F হল মধ্যাকর্ষন বল, ধরি m1 এবং m2 দুটি মহাবিশ্বের মাঝে অবস্থিত বস্তু এবং r হল তাঁদের মধ্যকার দূরত্ব। G=6.67428×10^-11)। আর তারকাটি যত বেশী উত্তপ্ত হবে তার জ্বালানী তত তাড়াতাড়ি ফুরিয়ে যাবে। একটি তারকার জ্বালানী ফুরিয়ে গেলে সেটা ধীরে ধীরে শীতল হতে থাকে এবং সঙ্কুচিত হতে থাকে। তখন সেই তারকার কী হয় বা কী ঘটে?
এই প্রশ্নের উত্তর পাওয়া গিয়েছিল ঊনিশশো কুঁড়ির দশকের শেষের দিকে ঊনিশশো আটাশ সালে। এর সমাধান করেছিলেন ভারতের একজন গ্রাজুয়েট ছাত্র যার নাম সুব্রহ্মান্যান চন্দ্রশেখর (Subrahmanyan chandrasekhar) । তিনি কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে স্যার আর্থার এডিংটনের কাছে পড়বার জন্য যখন জাহাজে করে ইংল্যন্ডের দিকে রওয়ানা হন। তখন তিনি অঙ্ক কষে বের করেছিলেন যে, ব্যবহারের ফলে যখন একটি তারকার সমস্ত জ্বালানী ফুরিয়ে যায় তখন নিজের মহাকর্ষের বিরুদ্ধে নিজেকে বহণ করতে হলে একটি তারকার ভর কত হতে হবে?
তার চিন্তাটি ছিল এ রকম- তারকা যখন ধীরে ধীরে ক্ষুদ্র হয়ে যায় তখন তারকার সমস্থ পদার্থ কণিকাগুলো খুব কাছাকাছি এসে যায় , সুতরাং পাউলির অপবর্জন তত্ত্ব (একটি পরমাণুতে অবস্থানরত ইলেকট্রনগুলোর নিজেদের মধ্যে অন্তত পক্ষে একটি কোয়ান্টাম সংখ্যার মান ভিন্ন থাকতেই হবে) অনুসারে তাদের বিভিন্ন গতিবেগ হওয়া আবশ্যিক । এজন্য কণিকাগুলো পরস্পর থেকে দূরে চলে যেতে থাকে । যার ফলে তারকাগুলিতে প্রসারণের চেষ্টা দেখা দেয়। ঠিক যেমন তারকাটির জীবনের শুরুতে মহাকর্ষীয় তত্ত্বের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করেছিল উত্তাপ । তেমনি মহাকর্ষীয় আকর্ষণ এবং অপবর্জন তত্ত্ব ভিত্তিক বিকর্ষণের ভারসাম্য রক্ষিত হলেই তারকাটি তার নিজস্ব ব্যাসার্ধ অপরিবতির্ত রাখতে পারে। কিন্তু চন্দ্রশেখর বুঝতে পেরেছিলেন অপবর্জন তত্ত্ব ভিত্তিক বিকর্ষণের একটি সীমা আছে । আইনস্টাইনের অপেক্ষবাদ তারকাটির ভিতরকার সমস্ত পদার্থ কণিকাগুলির গতিবেগের পার্থক্যের সীমা বেঁধে দিয়েছে । এই সীমা হল আলোকের দ্রুতি (আলোকের দ্রুতি প্রতি সেকেন্ডে প্রায় তিন লক্ষ কিলোমিটার ) । অর্থাৎ তারকাটি যথেষ্ট ঘন হলে অপবর্জন তত্ত্বভিত্তিক বিকর্ষণ মহাকর্ষীয় আকর্ষণের চাইতে কম হবে । চন্দ্রশেখর হিসাব করে দেখেছিলেন শীতল তারকার ভর অর্থাৎ তারকার জ্বালানী ফুরিয়ে যাওয়ার পর সৃষ্ট শীতল তারকার ভর আমাদের সূর্যের ভরের দেড় গুণের চাইতে বেশী হলে সে নিজের মহাকর্ষের আকর্ষণ হতে নিজেকে রক্ষা করতে পরবেনা । [বলে রাখা আবশ্যক যে , সূর্যের ভর 1.9891*10^30 বা ১.৯৮৯১ টাইমস ১০ টু দি পাওয়ার ৩০] । যদি তারকাটি নিজের মহাকর্ষ আকর্ষণ হতে নিজেকে রক্ষা করতে না পারে তাহলে তার পরিণতি কী হবে? এই প্রশ্নের উত্তর একটু পরেই আলোচনা করছি।
উনিশশো কুড়ির দশকের শেষের দিকে চন্দ্রশেখর এবং রুশ বিজ্ঞানী লেভ ডেভিডোভিচ ল্যান্ডো তারকার ভর নিয়ে কাজ করছিলেন । চন্দ্রশেখর দেখালেন শীতল তারকার ভর যদি সূর্যের ভরের দেড় গুণের চাইতে বেশী হয় তাহলে সেটি নিজেই নিজেকে রক্ষা করতে পারবেনা। এই ভরের সীমাকে চন্দ্রশেখর লিমিট বলা হয় ( চন্দ্রশেখর সীমা হল- স্থিতিশীল শীতল কোন শ্বেত বামন তারকার সম্ভাব্য সর্বোচ্চ ভর। ভর এর চাইতে বেশী হলে তারকাটি চুপসে কৃষ্ণবিবরে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। একটি শ্বেত বামন তারকার জন্য এই ভরের মান ১.৪১ সৌরভর এর সমান)। কিন্তু একসময় চন্দ্রশেখরের শিক্ষক আর্থার এডিংটন চন্দ্র শেখর লিমিটকে মানতে নারাজ হন । চন্দ্রশেখর ছিলেন ব্যাপক অপেক্ষবাদ সম্পর্কে একজন বিশেষজ্ঞ। কথিত আছে তাদের সময়ে তিনজন ব্যক্তি ব্যাপক অপেক্ষবাদ খুব ভাল করে বুঝাতেন। সেই তিনজন হলেন আইনস্টাইন, আর্থার এডিংটন এবং চন্দ্রশেখর। চন্দ্রশেখরের গবেষণাকে যখন তারই শিক্ষক মানতে নারাজ হলেন তখন তিনি এই ক্ষেত্র পরিত্যাগ করেন। তারপর জ্যোতির্বিজ্ঞানের অন্যক্ষেত্রে গবেষণা শুরু করেন। কিন্তু ১৯৮৩ সালে তাঁর এই গবেষণার জন্যই তাকে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা হয়।
একটি তারকার ভর যদি চন্দ্রশেখর সীমার চাইতে কম হয় বা সূর্যের ভরের সমান হয় তাহলে সেই তারকাকে অল্পভর সম্পন্ন তারকা বলে। এরূপ তারকার জ্বালানী ফুরিয়ে গেলে কেন্দ্রে মহাকর্ষজনিত সংকোচনের ফলে প্রচন্ড উত্তাপের সৃষ্টি হয়। এ উত্তাপের ফলে বাইরের এলাকা স্ফীত হয়ে এটি একটি রক্তিম দৈত্যে অর্থাৎ রেড জায়ান্টে পরিণত হয় । এক পর্যায়ে রক্তিম দৈত্যের বাইরের আবরণ কেন্দ্রীয় অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। অর্থাৎ তখন তারকাটি সম্ভাব্য অন্তিম দশায় পরিণত হয়। এই অন্তিম দশা বা বাইরের আবরণ বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর যে কেন্দ্রিয় অংশ থাকে সেই কেন্দ্রিয় অংশকে হোয়াইট ডোয়ার্ফ বা শ্বেত বামন বলে। শ্বেত বামন বা হোয়াইট ডোয়ার্ফের ব্যসার্ধ হয় কয়েক হাজার মাইল আর ঘনত্ব হয় প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে প্রায় কয়েকশ টন। শ্বেত বামনের নিজ পদার্থের ভিতরকার ইলেকট্রনগুলির অন্তর্বর্তী অপবর্জন তত্ত্বভিত্তিক বিকর্ষণই একটি শ্বেত বামনকে রক্ষা করে।
এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে , বিজ্ঞানী রিচার্ড এইচ ডুরিসেন ১৯৭৫ সালে দেখান যে, দ্রুত এবং বিভিন্ন অংশে ভিন্ন ভিন্ন ঘূর্ণন হার বিশিষ্ট তারার জন্য চন্দ্রশেখর ভরের মানের কিছু পরিবর্তন হতে পারে আর তা ১.৪১ থেকে ৩ সৌরভরের সমান হতে পারে। শ্বেত বামন তারার ভর বেশি হলে মহাকর্ষ বল একে সংকুচিত করে ফেলার চেষ্টা করে। ফলে এর অন্তর্গত ইলেকট্রনগুলি উচ্চতর শক্তি স্তরে পৌছে এবং এদের গতিবেগ বাড়তে থাকে। গতিবেগ বাড়ার সাথে সাথে চাপও বাড়তে থাকে। পদার্থের এধরনের অবস্থাকে বা পরিস্থিতিকে বলা হয় অপজাত অবস্থা (Degenerate Matter)। মহাকর্ষের ক্রমবর্ধমান চাপে একই কোয়ান্টাম স্তরে একাধিক ইলেকট্রন থাকার প্রবণতা দেখা যায়। কিন্তু ইলেকট্রন হলো ফার্মিয়ন কণা। ফার্মিয়ন কণারা ফার্মি-ডিরাক পরিসংখ্যান মেনে চলে। এরা পাউলির অপবর্জন নীতি মেনে চলে। (পাউলির অপবর্জন নীতি অনুযায়ী একই কোয়ান্টাম স্তরে একাধিক ইলেকট্রন থাকতে পারে না) এক্ষেত্রে একাধিক ইলেকট্রনকে একই কোয়ান্টাম স্তরে আসতে বাধ্য করা হলে এরা এক ধরনের চাপ দেয় যা ফার্মি-চাপ বা অপজাত চাপ নামে পরিচিত। এই চাপের উপস্থিতিতে তারাটি অন্তর্মুখী মহাকর্ষ বলকে কোনক্রমে ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হয় এবং শ্বেত বামনে পরিণত হয়। চন্দ্রশেখর গাণিতিকভাবে দেখান যে, সর্বোচ্চ যে ভর থাকলে তারাটি এই অবস্থায় পৌছাতে পারে তা হল ১.৪১ সৌরভরের সমান। এরচেয়ে বেশী ভরবিশিষ্ট তারা কৃষ্ণবিবরে পরিণত হতে পারে।
প্রথম যে কয়টি এই ধরনের তারকা আবিষ্কার হয়েছিল তার ভিতরে একটি হল সিরিয়াস নামক তারকা । সিরিয়াস রাতের আকাশের একটি উজ্জল তারকা ।
আমাদের সূর্যের জ্বালানী ফুরিয়ে যেতে এখনো প্রায় পাঁচশো কোটি বছরের প্রয়োজন। অর্থাৎ আরো পাঁচশো কোটি বছর পর আমাদের এই সূর্য রক্তিম দৈত্যে , তারপর শ্বেত বামনে পরিণত হতে পারে। কিন্তু লেভ ডেভিডোভিচ ল্যান্ডো তারকার সম্ভাব্য আরো একটি অন্তিম দশার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন। তিনি দেখিয়েছিলেন কিছু কিছু তারকার ভরের সীমা সূর্যের এক কিংবা দুই গুণের ভিতরে কিন্তু আকারে এরা শ্বেত বামনের চাইতেও ছোট। এই তারকা গুলিকেও রক্ষা করে অপবর্জন তত্ত্বভিত্তিক বিকর্ষণ । কিন্তু এই বিকর্ষণ আন্ত নিউট্রন এবং প্রোটনের তবে আন্ত ইলেকট্রনের নয় । সেজন্যে এগুলোকে বলা হয় নিউট্রন তারকা। সেগুলোর ব্যাসার্ধ হয় মাত্র দশ মাইলের মতো। কিন্তু তাদের ঘনত্ব হয় প্রতি ঘন ইঞ্চিতে প্রায় কোটি কোটি টন।
কোন তারকার ভর যদি চন্দ্রশেখর লিমিটের চাইতে বেশী হয় তাহলে তার পরিণতি এক পর্যায়ে ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণ বিবরে পরিণত হবে। এই কৃষ্ণবিবর বা ব্ল্যাক হোল শব্দাটির উৎপত্তি খুব সম্প্রতি । ১৯৬৯ সালে জন হুইলার নামে একজন আমেরিকান বিজ্ঞানী এই শব্দটি ব্যবহার করেন।
সূযের্র চেয়ে অনেকগুণ বেশী ভরসম্পন্ন তারকাকে বেশী ভরসম্পপ্ন তারকা বলা হয়। এ ধরনের তারকার জ্বালানী ফুরিয়ে গেলে তারকা গুলিকে বিরাট সমস্যায় পড়তে হয়। কোন কোন ক্ষেত্রে জ্বালানি ফুরিয়ে যাবার পর মহাকষর্ণ জনিত সংকোচন খুব বেশী বৃদ্ধি পায়। ফলে প্রচণ্ড উত্তাপের সৃষ্টি হয় এবং তারকাটি বিস্ফোরিত হয়। একেই বলে সুপার নোভা বিস্ফোরণ । আবার কোন কোন ক্ষেত্রে নক্ষত্র নিজেদের ভর সীমার ভেতরে নিয়ে আসবার মতো যথেষ্ট পরিমাণ পদার্থ পরিত্যাগ করতে সক্ষম হয়। এই পদার্থ পরিত্যাগ করার পর অবশিষ্ট যে ভর থাকে তার মান অনুযায়ী দুই রকম ফল পাওয়া যেতে পারে। ভর যদি দুই সৌরভরের চেয়ে বেশী হয় তাহলে সেটি সাধারণত একটি ব্ল্যাকহোলে পরিণত হবে। এই ব্ল্যাকহোলের আয়তন সসীম কিন্তু ভর প্রায় অসীম । এ কারণে ঘনত্ব, অভিকর্ষজ ত্বরণ মুক্তিবেগ ইত্যাদিও প্রায় অসীম। কৃষ্ণ বিবরের মহাকর্ষীয় আকর্ষণ এত প্রবল যে কোন বস্তু এর মধ্যে প্রবেশ করলে বা নাগালের মধ্যে আসলে আর বাইরে আসতে পারেনা। এমনকি আলোক কণিকা ফোটনও এই আকর্ষণ থেকে মুক্ত হতে পারে না। কৃষ্ণ বিবর থেকে নির্গত কোন প্রকার ফোটন বা আলোক রশ্মি বেশি দূর যাওয়ার আগেই অর্থাৎ কৃষ্ণ বিবিরের বাইরের সীমানার কাছাকাছি আসার আগেই কৃষ্ণ বিবরের মহাকর্ষীয় আকর্ষণ তাকে টেনে পেছনে নিয়ে আসবে।
ঘটনাটি এই রকম- তারকার মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র স্থান কাল (space-time) আলোক রশ্মির গতিপথের পরিবর্তন করে। অর্থাৎ তারকাটি না থাকলে যে গতিপথ হওয়ার কথা ছিল তার তুলনায় অন্য রকম হয়। যে আলোক শঙ্কুগুলি স্থান কালে তাদের অগ্র ভাগ থেকে নির্গত আলোকের গতিপথ নির্দেশ করে তারকার পৃষ্ঠের কাছাকাছি সেগুলো ভেতর দিকে সামান্য বেঁকে যায়। তারকাটি যেমন ধীরে ধীরে সঙ্কুচিত হতে থাকে তার মহাকর্ষীয় ক্ষেত্রও ধীরে ধীরে শক্তিশালী হতে থাকে। আর মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র যত বেশী শক্তিশালী হবে আলোক রশ্মি ততবেশী বেঁকে যাবে। এর ফলে আলোকের নির্গত হওয়া আরো কঠিন হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত তারকাটি যখন সঙ্কুচিত হয়ে একটি বিশেষ ক্রান্তিক ব্যাসার্ধ প্রাপ্ত হয় তখন পৃষ্ঠের মহাকর্ষীর ক্ষেত্র এমন শক্তিশালী হয় যে আলোক শঙ্কু ভিতর দিকে বেঁকে যায়। সেই বক্রতা এত বেশী হয় যে আলোক আর সেখান থেকে নির্গত হতে পারে না।
মহাকর্ষীয় আকর্ষণে আলোক আটকে যাওয়ার এ ধারণাটি প্রথম প্রকাশ করেন বৃটিশ ভূ-তত্ত্ববিদ জন মিচেল ১৭৮৩ সালে। তিনি বিজ্ঞানী হেনরি ক্যাভেন্ডিসকে চিঠির মাধ্যমে জানান বিপুল পরিমাণ ভর বিশিষ্ট কোন বস্তু, যার মহাকর্ষের প্রভাবে আলোক তরঙ্গ পর্যন্ত পালাতে পারেনা। তারপর একই মতবাদ প্রকাশ করেন ফরাসি গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী পিয়েরে সিমো লাপ্লাস ১৭৯৬ সালে। কিন্তু তাদের এই ধারণাটি প্রকটভাবে উপেক্ষিত হয়। কারণ সবার বোধগম্য হয়নি যে, আলোর মত ভরহীন তরঙ্গ কিভাবে মধ্যাকর্ষণ শক্তি দ্বারা প্রভাবিত হবে। (এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, আলো কণা এবং তরঙ্গ দুই ধরনেরই আচরণ করতে পারে )
বোধগম্যহীন জটিল এই সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান হয় নোবেল পুরস্কার বিজয়ী জার্মান পদার্থবিদ বিজ্ঞানী আলবার্ট আইনষ্টাইনের আপেক্ষিকতা তত্ত্ব আবিষ্কারের মাধ্যমে। তবে আপেক্ষিকতা তত্ত্ব আবিস্কারের পূর্বেই মধ্যাকর্ষণ শক্তি দ্বারা আলোর গতি প্রভাবিত হওয়ার ব্যাপারটি প্রমাণিত হয়েছিল।
অপেক্ষবাদ অনুসারে আলোকের চেয়ে দ্রুতগামী কিছু হতে পারেনা । সুতরাং কৃষ্ণবিবর থেকে আলোকই যদি মুক্ত হতে না পারে তাহলে আর কিছুই মুক্ত হতে পারবেনা। এর মহাকর্ষীয় ক্ষেত্র সবকিছুকে টেনে পেছনে নিয়ে যাবে।
অতি বিশাল, কালো আর শক্তিশালী এই কৃষ্ণ বিবরের কোন প্রত্যক্ষ প্রমাণ এখন পর্যন্ত বিজ্ঞানীদের হাতে এসে পৌছায়নি। কিন্তু নক্ষত্রের অবস্থান, নক্ষত্রের আচরণ, দূরত্ব ইত্যাদি বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে ধারণা করা হয় যে, এই মহাবিশ্বে কৃষ্ণ বিবরের উপস্থিতি রয়েছে । ধারণা করা হয়ে থাকে বেশীরভাগ গ্যালাক্সিই তার মধ্যস্থ কৃষ্ণ বিবরকে কেন্দ্র করে ঘূর্ণনয়মান রয়েছে।
যেহেতু কৃষ্ণ বিবর থেকে কোন প্রকার বস্তু বা আলোক রশ্মি বেরিয়ে আসতে পারেনা তাই কৃষ্ণ বিবরের অনুপস্থিতির ব্যাপারে এটাও একটা কারণ হতে পারে। তবে বিজ্ঞানীরা কৃষ্ণ বিবরের উপস্থিতির ব্যাপারটা নির্ধারণ করেন কোন স্থানের নক্ষত্রের গতি ও দিক গবেষণা করে। এছারাও বিভিন্ন গ্যালাক্সীর ভর, ঘূর্ণন, অবস্থান ইত্যাদি থেকেও কিছুটা ধারণা করা হয়ে থাকে।
কৃষ্ণ বিবরের সীমানাকে বলা হয় ঘটনা দিগন্ত আর কৃষ্ণ বিবরের ব্যাসার্ধকে বলা হয় সোয়ার্জ চাইল্ড ব্যাসার্ধ (জার্মান পদার্থ বিজ্ঞানী কার্ল সোয়ার্জ চাইল্ড Karl Schwarzschild এর নামানুসারে কৃষ্ণ বিবরের ব্যাসার্ধের নামকরণ করা হয়েছে সোয়ার্জ চাইল্ড ব্যাসার্ধ। উনিশ ষোল সালে তিনি বিজ্ঞানী আইনস্টাইনের "ফিল্ড ইকোয়েশন " নিয়ে কাজ করতে গিয়ে এই ব্যাসার্ধের প্রস্তাব করেন)। একটি তারকা সোয়ার্জ চাইল্ড ব্যাসার্ধ প্রাপ্ত হয় তখনই যখন কোনো তারকা ক্রান্তিক ব্যাসার্ধ প্রাপ্ত হয় ।
কৃষ্ণ বিবরকে ভাগ করা হয় তার মাঝে থাকা ভর, আধান , কৌণিক ভরবেগের উপর ভিত্তি করে। অনেক কৃষ্ণ বিবর আছে যাদের শুধু ভর আছে কিন্তু আধান বা কৌণিক ভরবেগ নেই । এগুলোকে বলা হয় সোয়ার্জ চাইল্ড কৃষ্ণ বিবর ।
ভরের উপর ভিত্তি করে বলা যায় চার ধরনের কৃষ্ণ বিবরের কথা। যেমন-
১. Super Massive Blackhole (সুপার মেসিভ ব্ল্যাকহোল)
২. Intermediate Blackhole (ইন্টারমিডিয়েট ব্ল্যাকহোল)
৩. Steller Blackhole ( স্টেলার ব্ল্যাকহোল)
৪. Micro Blackhole (মাইক্রো ব্লাকহোল)
এ সকল কৃষ্ণ বিবর ছাড়াও চার্জড ব্লাকহোল (Charged Blackhole), রোটেটিং ব্লাকহোল (Rotating Blackhole) এবং ষ্টেশনারী ব্লাকহোলের (Stationary Blackhole) বর্ণনা পাওয়া যায় ঝথাক্রমে- Reissner-Nordstrom metric , Kerr metric এবং Kerr-Newman metric এর সাহায্যে ।
বর্তমানে এই ব্ল্যাকহোল নিয়ে পদার্থবিজ্ঞানী ষ্টিফেন ডব্লিউ হকিং তাঁর "এ ব্রিফ হিস্টরী অফ টাইম" বইয়ে বিভিন্ন ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। যা প্রমাণিত হলে যুগান্তকারী সৃষ্টি বলে প্রমাণিত হবে এই পৃথিবীতে।
Guest Writer: F Ahmed
Published 16.02.2017