রকেটের জ্বালানি

চিত্রঃ অরিয়ান-৫ রকেট, দুপাশে ২টি সলিড রকেট বুস্টার যা পৃথিবীর নিম্ন-বায়ুমন্ডল পার হতে সহায়তা করে, মাঝের অংশটি মুল রকেটের ইঞ্জিন যা সাধারনত তরল হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের মিশ্রণে তৈরি। Credit: Arianespace.

রকেট ইঞ্জিন মানুষের সৃষ্ট সবচেয়ে শক্তিশালী যন্ত্র, মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে একটি রকেট কয়েক টন ওজনের ভারী বস্তুকে পৃথিবীর সীমানা ছাড়িয়ে মহাশূন্যে নিয়ে যেতে পারে। ভূপৃষ্ঠ থেকে পৃথিবীর নিম্ন-কক্ষপথে যেতে রকেটের প্রায় ৮ মিনিটের মত সময় লাগে। আজকে এখানে আলোচনা হবে রকেটের জ্বালানি নিয়ে। সাধারন গাড়িতে পেট্রোল, ডিজেল জ্বালানি হিসেবে ব্যাবহার করা হয়, আবার নতুন ধরনের গাড়িতে ইলেক্ট্রিক/তড়িৎ শক্তি ব্যাবহার করা হয়। জ্বালানির ব্যাবহারের উপর ভিত্তি করে ইঞ্জিনও আলাদা হয় (ডিজেল, পেট্রোল ইঞ্জিন, EV) , ঠিক তেমনি রকেটের অনেক ধরনের জ্বালানি রয়েছে এবং রকেটের ইঞ্জিনও আলাদা হয় জ্বালানির উপর ভিত্তি করে। নিচে কিছু বহুল ব্যবহৃত রকেট  জ্বালানি ও রকেট ইঞ্জিন নিয়ে আলোচনা করা হবে।

রকেট ইঞ্জিন অনেক ধরনের হতে পারে, বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন অংশে বায়ুর চাপ ভিন্ন, সেই অনুযায়ী রকেটের ইঞ্জিনের নকশাও ভিন্ন হয়, যেমন ভূপৃষ্ঠের কাছে বায়ুর চাপ বেশি, কিন্তু ৫০ কিমি উপর বায়ুর চাপ অনেক কম।  বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন ধরনের রকেট ব্যাবহার করা হয় এবং বিভিন্ন রকেটের জ্বালানিও আলাদা হয়।

জালানির ধরনের উপর ভিত্তি করে রকেট কয়েক ধরনের হতে পারেঃ

-         কঠিন/সলিড রকেট ইঞ্জিন/ জ্বালানি

-         তরল রকেট ইঞ্জিন / জ্বালানি

-         অন্যান্যঃ তড়িৎ, পারমাণবিক শক্তি ইত্যাদি

কঠিন/সলিড রকেট

এই ধরনের রকেটে জ্বালানি ও অক্সিডাইজার মিশিয়ে সিলিন্ডারের ভিতর রাখা হয়।  যখন ইঞ্জিন চালু করা হয়, তখন জ্বালানি পুড়ে উত্তপ্ত গ্যাস নযোল দিয়ে নির্গত হয়ে রকেটের গতি প্রদান করে। কঠিন/সলিড রকেট অল্প সময়ে প্রচুর শাক্তি উৎপাদন করে যা বায়ুমণ্ডলের নিম্নস্তর থেকে বের হতে সাহায্য করে। উদাহরন সরূপ, নাসার স্পেস সাটলে SRB-তে জ্বালানি হিসেবে এলুমিনাম পাঊডার এবং অক্সিডাইজার হিসেবে ( জালানিকে  জ্বলতে সাহায্য করে) আমোনিয়াম-পারক্লোরেট ব্যাবহার করে।  একটি রকেট বিভিন্ন ধাপে মহাকাশে পাঠানো হয়, প্রথম ধাপে সাধারনত কঠিন জ্বালানি ব্যাবহার করা হয়, অনেক সময় কঠিন ও তরল জ্বালানি একসাথে ব্যাবহার করা হয় প্রথম ধাপে।

কঠিন জালানির সুবিধা হল, অল্প সময় প্রচুর বল তৈরি করতে পারে যা রকেটকে পৃথিবীর মুক্তিবেগ পেতে সাহায্য করে। অসুবিধা হল, একবার ইঞ্জিন চালু হলে তা বন্ধ করার উপায় নেই।

তরল জ্বালানি


এই ধরনের রকেটে জ্বালানি ও অক্সিডাইজার হিসেবে তরল জ্বালানি ব্যাবহার করা হয়। জ্বালানি ও অক্সিডাইজার আলাদা সিলিন্ডারে রেখে পাম্পের মাধ্যমে কমবাস্টন চেম্বারে পাঠানো হয়। কমবাস্টন চেম্বারে জালানি ও অক্সিডাইজার পুড়ার ফলে উচ্চ চাপ ও তাপে গ্যাস রকেটের নযল দিয়ে নির্গত হয়, ঠিক এভাবেই রকেট গতি লাভ করে।

তরল জ্বালানি রকেটের বিভিন্ন পর্যায়ে ব্যাবহার করা হয় এবং তরল জ্বালানি সবচেয়ে বেশি ব্যাবহার  করা হয়। তরল জ্বালানির সুবিধা হল, রকেটের যেকোনো পর্যায়ে ব্যাবহার করা যায়, সহজলভ্য,  ইঞ্জিন যেকোনো সময় অন/অফ করা যায়। অসুবিধার মধ্যে হল, তরল জ্বালানি ওজনে বেশি বলে দুরপাল্লার মিশনের জন্য উপযুক্ত নয়। সুপরিচিত নাসার স্পেস শাটলে তরল হাইড্রোজেন ও তরল অক্সিজেন ব্যাবহার করা হত। রাশিয়ার সয়ুজ রকেটে RP-1 ( কেরোসিনের মত ) ও তরল অক্সিজেন ব্যাবহার করা হয়। রকেট পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল থেকে সফল ভাবে পার হাওয়ার পর অন্য ধরনের তরল জালানি ব্যাবহার করে, বিশেষ দুরপাল্লার মিশন বা দীর্ঘ সময় ধরে চলমান মিশনে নাইট্রোজেন–টেট্রাঅক্সাইড (N2O4) এবং হাইড্রাজিন (N2H4) ব্যাবহার করা হয়।  

চিত্রঃ অরিয়ান-৫ রকেটের বিভিন্ন অংশ, দুপাশে দুটি সলিড রকেট বুস্টার, মাঝের অংশ (নিচে) Main Cryogenic Stage বায়ুমণ্ডলের নিচের অংশে চালু হয় এবং রকেটকে বায়ুমণ্ডল পার করার পর বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।  Cryogenic Upper stage (মধ্য অংশ) ইঞ্জিন চালু হয় যখন Main Cryogenic Stage বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় মুল রকেট থেকে।  Credit: Arianespace.

অন্যান্য

তড়িৎ

তড়িৎ শক্তি ব্যাবহার করেও রকেট চালানো যায়, এই পদ্দতিতে তরল জ্বালানির বদলে তড়িৎ শক্তি ব্যাবহার করা হয়, এই শক্তি জোগান দেয় সৌর অথবা পারমাণবিক শক্তি। সাধারন তরল জ্বালানির জন্য নভোযানকে অনেক জালানি পরিবহন করতে হয়, যা অনেক সময় অতিরিক্ত বোঝা হয়ে দাড়ায় এবং ব্যায়বহুল ও জটিল। এই ধরনের সমস্যার জন্য তড়িৎ শক্তি একটি উত্তম সমাধান। তড়িৎ শক্তি ব্যাবহার করে রকেট অনেক দুরের গ্রহে সহজেই পাঠানো সম্ভব হবে।

কিভাবে কাজ করে ? তড়িৎ শক্তির উৎস হতে পারে, সূর্য অথবা পারমাণবিক শক্তি, তারপর সেই শক্তি দিয়ে গ্যাসকে আয়নিত করা হয় , গ্যাস হিসেবে জেনন, ক্রিপ্টন, আর্গন ব্যাবহার করা হয়। তারপর সেই আয়নিত গ্যাসকে তড়িৎ ও চৌম্বকক্ষেত্র মধ্য দিয়ে প্রবাহিত করা হয়, ফলাফল হিসেবে আয়নিত গ্যাস দ্রুত বেগে রকেট থেকে নির্গত হয়ে রকেটের গতি তরান্বিত করে। নাসার ডন মিশনে এই ধরনের ইঞ্জিন ব্যাবহার করা হয়েছে। ইলেক্ট্রিক প্রপালসনের অনেক সুবিধা রয়েছে, জ্বালানি কম খরচ হয়, দীর্ঘ সময় ব্যাবহার করা যায়, খুব নিখুত ভাবে ইঞ্জিন নিয়ন্ত্রণ করা যায় এই পদ্দতিতে, কম জ্বালানি দরকার হয় ইত্যাদি । এই ধরনের সুবিধার জন্য এখন অনেক নভোযানে এই ইলেক্ট্রিক প্রপালসনের ব্যাবহার করা হয়। সবচেয়ে বেশি ব্যাবহার হয় কক্ষপথের উচ্চতা পরিবর্তন, গতি পরিবর্তন ও স্টেশন কিপিং ( কক্ষপথে নভোযানকে একটি নির্দিষ্ট অবস্থানে রাখা )  । তবে কিছু অসুবিধাও রয়েছে, এটি খুব অল্প পরিমানে বল প্রদান করে, সেজন্য রকেটের প্রাথমিক অবস্থায় ও পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ব্যাবহার সম্ভব নয়।

তড়িৎ প্রপালসন বিভিন্ন প্রকার হতে পারেঃ

-         আয়ন প্রপালসন

-         হল ইফেক্ট

-         তড়িৎ-চৌম্বকীয়  (ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক)

পারমাণবিক

আরেকটি উপায় হতে পারে পারমাণবিক জ্বালানি, জ্বালানি যদি (যেমন, হাইড্রোজেন) পারমাণবিক চুল্লির মধ্য দিয়ে প্রবাহিত করা হয়, তাহলে জ্বালানি নযল দিয়ে নির্গত হয়ে রকেট গতি সঞ্চার করবে। এই ধরনের রকেট এখনো তাত্ত্বিক ও গবেষণার পর্যায়ে আছে। বিজ্ঞানীরা এই প্রযুক্তি নিয়ে আশাবাদী, এই প্রযুক্তি সফলভাবে বাস্তবায়ন করতে পারলে ভবিষ্যতে পারমাণবিক রকেট দিয়ে অন্য গ্রহে মিশন পরিচালনা করা সহজ হবে এমনকি অন্য নক্ষত্রমণ্ডলীতেও মিশন চালানো যাবে।

Published Date: 07.06.2024

 

Bibliography

[1] NASA, “Solid Rocket Engine,” Nasa.gov, 2015. https://www.grc.nasa.gov/www/k-12/airplane/srockth.html (accessed 2024).

[2] NASA, “Liquid Rocket Engine,” Nasa.gov, May 13, 2021. https://www.grc.nasa.gov/www/k-12/airplane/lrockth.html (accessed 2024).

[3] ESA, “Nuclear powered rockets,” www.esa.int. https://www.esa.int/Education/Nuclear_powered_rockets (accessed 2024).

[4] MIT/SPL, “About Electric Propulsion | Space Propulsion Laboratory,” spacepropulsion.mit.edu. https://spacepropulsion.mit.edu/about-electric-propulsion (accessed 2024).

[5] “The Propulsion We’re Supplying, It’s Electrifying - NASA,” Oct. 22, 2020. Available: https://www.nasa.gov/humans-in-space/the-propulsion-were-supplying-its-electrifying/. [Accessed: May 24, 2024]