পৃথিবীর কক্ষপথ
মাধ্যাকর্ষণ বলের প্রভাবে মহাবিশ্বের সকল বস্তু একটি আরেকটিতে কেন্দ্র করে আবর্তন করে, বিশেষ করে বড়ো বস্তু শক্তিশালী মাধ্যাকর্ষণ বলের প্রভাবে ছোটো তার চারপাশে ঘুরতে থাকে, যেমন সূর্যকে কেন্দ্র করে গ্রহগুলু আবর্তন করে এবং গ্রহের প্রভাবে উপগ্রহ তার চারপাশে ঘুরতে থাকে। পৃথিবীর চারপাশে অন্যান্য বস্তু পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরপাক খায়, যেমন চাঁদ , স্যাটেলাইট। একটি বস্তু সাধারনত পৃথিবীকে কেন্দ্র করে যে পথে আবর্তন বা ঘুরপাক খায় , তা কক্ষপথ হিসেবে পরিচিত। অনেক ধরনের কক্ষপথ রয়েছে, পৃথিবী থেকে দূরত্ব ও কক্ষপথের গড়নের উপর ভিত্তি করে কক্ষপথকে কয়েক ভাবে ভাগ করা যেতে পারে , যেমনঃ
১। নিম্ন-কক্ষপথ LEO (Low Earth Orbit)
২। মধ্য-কক্ষপথ MEO (Medium Earth Orbit)
৩। জিও GEO (Geo-Stationary Orbit and Geo-Synchronous Orbit)
৪। মলনিয়া কক্ষপথ (Molniya)
৫। লাগ্রাজ পয়েন্ট (L-Points)
নিম্ন-কক্ষপথ LEO (Low Earth Orbit)
পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে ২০০০ কিমি উচ্চতা পর্যন্ত নিম্ন বা লিও কক্ষপথ হিসেবে পরিচিত। পৃথিবী থেকে এই কক্ষপথই সবচেয়ে কাছের এবং রকেট পাঠানো সহজ। অধিকাংশ স্যাটেলাইট এই কক্ষপথে থাকে যেমন আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন (ISS) ও হাবল টেলিস্কোপ। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন (ISS) পৃথিবী পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৪০০ কিমি উচ্চতায় প্রতি সেকেন্ডে ৭.৮ কিমি বেগে পৃথিবীকে আবর্তন করে। নিম্ন-কক্ষপথ LEO – এই উচ্চতায় সুবিধা এবং অসুবিধা ২টি রয়েছে।
সুবিধা –
- ভূপৃষ্ঠের কাছাকাছি থাকায় স্যাটেলাইটের সাথে যোগাযোগ সহজ
- কম খরচে মিশন পাঠানো যায়
- মানুশ্ববাহী মিশন পাঠানো সহজ
অসুবিধা –
- যোগাযোগ স্যাটেলাইট হিসেবে ব্যাবহার করা জটিল , অনেক স্যাটেলাইট দরকার
- বায়ুমণ্ডলের টান / ঘর্ষণ (atmospheric drag): এই কক্ষপথের স্যাটেলাইট বায়ুমণ্ডলের ঘর্ষণের ফলে স্যাটেলাইটের উচ্চতা আস্তে আস্তে কমে যায়।
- এই কক্ষপথের স্যাটেলাইট পৃথিবীকে খুব দ্রুত আবর্তন করে (যেমন, ISS দিনে ১৬ বার পৃথিবীকে প্রদক্ষিন করে) বিধায় গ্রাউন্ড স্টেশন বা ভু-উপগ্রহ কেন্দ্রকে সব সময় স্যাটেলাইটের দিকে তাক করে থাকতে হয় বা অনেক সময় ভু-উপগ্রহ কেন্দ্রের সাথে যোগাযোগ হারায়।
মধ্য-কক্ষপথ MEO (Medium Earth Orbit)
পৃথিবীর কক্ষপথের ২০০০ কিমি থেকে ৩৫,৭৮৬ কিমি পর্যন্ত এলাকাকে মধ্য-কক্ষপথ বা মিও হিসেবে পরিচিত। এই কক্ষপথের সবচেয়ে পরিচিত স্যাটেলাইট হলো জি-পি-এস যা নেভিগেসনের কাজে বাহুল ব্যবহৃত।
এই কক্ষপথের স্যাটেলাইটঃ জি-পি-এস ( যুক্তরাষ্ট্র ) , গ্লোনাস ( রাশিয়া), গ্যালিলও (ইউরোপ)
জিও GEO
(Geo-Stationary Orbit and Geo-Synchronous Orbit)
পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে ৩৫,৭৮৬ কিমি দূরে অবস্থিত এই গোলাকার কক্ষপথ জিও GEO নামে পরিচিত। কক্ষপথের এই অংশের একটি বিশেষ সুবিধা রয়েছে। জিও স্যাটেলাইট-এর আবর্তন কাল এবং পৃথিবীর নিজের অক্ষে আবর্তন কাল সমান মানে ২৪ ঘণ্টা। তার মানে, পৃথিবীর পৃষ্ঠ থেকে সব সময় স্থির মনে হবে। ঠিক এই কারনে টেলি-যোগাযোগের জন্য এই কক্ষপথ অত্যন্ত জনপ্রিয়, কারন গ্রাউন্ড স্টেশন বা ভু-উপগ্রহ কেন্দ্র থেকে সব সময় স্যাটেলাইট স্থির, সব সময় যোগাযোগ রক্ষ্যা করা যায় স্যাটেলাইটের সাথে। টেলি-যোগাযোগ ছাড়াও টিভি সম্প্রচার, জলবায়ু পর্যবেক্ষণ , বৈজ্ঞানিক কাজ এমনকি অন্য স্যাটেলাইটের সাথে যোগাযোগের জন্য এই কক্ষপথে অবস্থিত স্যাটেলাইট ব্যাবহার করা হয়। পৃথিবী থেকে অনেক উচ্চতায় থাকায় এই কক্ষপথে স্যাটেলাইট পাঠানো বেশ জটিল এবং ব্যায়বহুল। জিও (GEO) কক্ষপথের সুবিধা ও অসুবিধা দুইটি রয়েছে.
সুবিধা
- ভূপৃষ্ঠের সাপেক্ষে জিও স্যাটেলাইট সব সময় স্থির থাকে, অ্যান্টেনা সব সময় এক দিকে তাক করে থাকে, কোন দিক পরিবর্তনের প্রয়োজন হয় না।
- একটি স্যাটেলাইট দিয়ে পৃথিবীর এক-তৃতীয়াংশ কভারেজ দেয়া যায়, তার মানে তিনটি স্যাটেলাইট দিয়ে সম্পূর্ণ পৃথিবী কভারেজ দেয়া সম্ভব।
- একটি স্যাটেলাইট অনেক বড়ো এলাকা কভারেজ দিতে পারে, তাই অনেক দূরবর্তী এলাকা যেমন দ্বীপ, জাহাজ, বিমান ইত্যাদিতে যোগাযোগের জন্য জিও স্যাটেলাইট আদর্শ।
- বহুল ব্যবহৃত কক্ষপথ – এই কক্ষপথে অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্যাটেলাইট রয়েছে যেমন, টিভি, আবহাওয়া , যোগাযোগ (Communications) ইত্যাদি।
অসুবিধা
- স্যাটেলাইট নকশা জটিল হতে পারে
- ব্যায়বহুল প্রকল্প হতে পারে
- যেহেতু ভুপ্রিস্থ থেকে অনেক দূরে ( প্রায় ৩৬০০০ কিমি) থাকায় বেতার তরঙ্গ আসা-যাওয়া করতে একটু বেশি সময় লাগে। বেতার তরঙ্গের একবার ভুমি থেকে স্যাটেলাইটে আসা-যাওয়া করতে ৫৪০ মিলি-সেকেন্ড সময় লাগে, এই বিলম্বের কারনে অনেক সময় অসুবিধা তৈরি করে।
- উত্তর ও দক্ষিন মেরু এলাকায় কভারেজ দেয়া সম্ভব নয়।
মলনিয়া কক্ষপথ (Molniya)
এই কক্ষপথকে অনেকে মধ্য-কক্ষপথের অন্তর্ভুক্ত করেন, তবে পার্থক্য হলো অন্য অধিকাংশ কক্ষপথ বৃত্তাকার কিন্তু মলনিয়া উপবৃত্তাকার এবং বিষুবরেখার (Equator) সাথে কৌণিক ভাবে (63.4) পৃথিবীকে আবর্তন করে। এই ধরনের কক্ষপথের সুবিধা হলো উত্তর মেরু ও দক্ষিন মেরু অঞ্চলে কভারেজ দেয়া যায়। রাশিয়া এই ধরনের কক্ষপথে বেশ কিছু স্যাটেলাইট পাঠিয়েছে কারন রাশিয়ার অনেক এলাকা উত্তর মেরুর কাছাকাছি।
লাগ্রাজ পয়েন্ট (L-Points)
সূর্য ও পৃথিবীর কক্ষপথে ৫টি লাগ্রাজ পয়েন্ট রয়েছে, লাগ্রাজ পয়েন্ট হলো পৃথিবী ও সূর্যের কক্ষপথের পাঁচটি স্থান যেখানে সূর্য ও পৃথিবী মহাকর্ষ বল একটি আরেকটির বিপরীত দিকে কাজ করে, ফলাফল হলো এই পাঁচটি পয়েন্টে কোন স্যাটেলাইট থাকলে তা স্থির থাকে, সুবিধা হলো খুব অল্প জ্বালানিতে স্যাটেলাইট চালানো সম্ভব। L1 ও L2 পয়েন্টে বেশ কিছু বৈজ্ঞানিক গবেষণা স্যাটেলাইট রয়েছে।
L1 Point: SOHO (Solar and Heliospheric Observatory Satellite)
L2 Point: JWST (James Webb Space Telescope), Planck Satellite
তথ্যসুত্র
[1] “Catalog of Earth Satellite Orbits,” Sep. 04, 2009. Available: https://earthobservatory.nasa.gov/features/OrbitsCatalog#:~:text=Two%20medium%20Earth%20orbits%20are,hours%20to%20complete%20an%20orbit. [Accessed: 2024]
[2] “Types of orbits.” Available: https://www.esa.int/Enabling_Support/Space_Transportation/Types_of_orbits. [Accessed: 2024]
[3] “What is a Lagrange Point? - NASA Science.” Available: https://science.nasa.gov/resource/what-is-a-lagrange-point/. [Accessed: 2024]