স্পুটনিক-২ : প্রথম নভোচারী লাইকা

চিত্রঃ নভোচারী কুকুর লাইকা

লাইকা ছিল মস্কো শহরের রাস্তা থেকে তুলে আনা একটি কুকুর, এই কুকুর ছাড়াও আরও বেশ কিছু কুকুর ছিল বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য। লাইকা ছিল ৬ কেজি ওজনের এবং বিজ্ঞানীরা তাকে বিভিন্ন ভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু করেন, যেমন কিভাবে ছোট নভোযানের কেভিনের/রুমের মধ্যে থেকে খাওয়া দাওয়া নড়া চড়া করবে। নভোযানের মধ্যে কয়েকদিনের মত খাবার মজুত ছিল। রকেট যাত্রার আগে ডাক্তাররা লাইকার শরীরে বিভিন্ন সেন্সর ও যন্ত্রপাতি এঁটে দেন যাতে সব সময় পর্যবেক্ষণ করা যায়, বিশেষ করে রক্ত চাপ, হৃদপিণ্ডের স্পন্দন, শাস-প্রশ্বাস ইত্যাদি। রকেট যাত্রার পর নিয়ন্ত্রনকক্ষ থেকে বিভিন্ন শারিরিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করা হয়, যাত্রার শুরুর দিকে লাইকার হৃদপিণ্ডের স্পন্দন, শাস-প্রশ্বাস গতি বেড়ে যায় হয়ত রকেটের শব্দ ও নড়াচড়ায় আতঙ্কগ্রস্থ হয়ে পড়েছিল, পড়ে আস্তে আস্তে খাওয়া দাওয়া শুরু করে। সর্বশেষ পরিনতি সম্পর্কে সব তথ্য জানা নেই, তবে কয়েক ঘণ্টা বা কয়েকদিনের মধ্যে লাইকা মৃত্যুর কলে ঢলে পড়ে।

স্পুটনিক-২ ছিল ৫০৮ কেজি ওজনের স্যাটেলাইট, তখনকার দিনে সেটা ছিল অনেক বড় এবং ভারি নভোযান, স্পুটনিক-১ ছিল মাত্র ৮৩ কেজি ওজনের। বিভিন্ন ধরনের বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ছিল এই নভোযানে যেমন সূর্যের রেডিয়েশন মাপার যন্ত্র, কসমিক রশ্মি , তাপমাত্রা ও চাপ মাপার যন্ত্র ছিল, তাছাড়া ভু-উপগ্রহ কেন্দ্রের সাথে যোগাযোগের জন্য ছিল টেলিমেট্রি যোগাযোগ ব্যাবস্থা। ১৯৫৭ সালের ৩রা নভেম্বর বাইকানর কসমোড্রোন ( বর্তমানে কাজাখস্তানে অবস্থিত ) থেকে যাত্রা শুরু হয় এই মিশনের। নভোযান পৃথিবী থেকে ১৫০০ কিমি উচ্চতায় পৃথিবীকে প্রদক্ষিন করা শুরু করে এবং প্রতি ১০২ মিনিটে পৃথিবীকে একবার আবর্তন করে। লঞ্চ ভেহিকল হিসেবে ব্যাবহার করা হয় Sapwood SS-6 8K71PS রকেট, এটা আসলে আন্তঃমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র আরেকটি পরিমার্জিত রূপ। এখানে একটি ব্যাপার পরিষ্কার করে বলে উচিত, সাধারন ভাবে আমরা যাকে নভোযান বা স্যাটেলাইট মিশন বলি, সেটার দুটি অংশ থাকে, লঞ্চ ভেহিকল ও পে-লোড। লঞ্চ ভেহিকল যাত্রা শুরু করে এবং পে-লোড কে কক্ষপথে দিয়ে আসে আর পে-লোড হল আসল স্যাটেলাইট বা নভোযান। পে-লোডে থাকে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি, তথ্য-যোগাযোগের ব্যাবস্থা এবং পে-লোড বা স্যাটেলাইট কক্ষপথে বিচরণ করে নির্দিষ্ট কাজ করে যেমন, তথ্য আদাম প্রদান, বায়ুমণ্ডলের তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ ও অন্যান্য কাজ। স্পুটনিক-২ প্রায় ১৬২ দিন পৃথিবীকে আবর্তনের পর ১৯৫৮ সালের ১৪ই এপ্রিল পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ফিরে আসে এবং ঘর্ষণের ফলে আগুনে পুড়ে যায় নভোযান।

চিত্রঃ স্পুটনিক-২ এর মডেল ( Credit: Wikipedia)

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দুই পরাশক্তির মধ্যে শুরু হয় মহাশূন্য বিজয়ের প্রতিযোগিতা। এই প্রতিযোগিতার আনুষ্ঠানিক সুত্রপাত ঘটে ১৯৫৭ সালের ৪ঠা অক্টোবর, যখন সোভিয়েত রাশিয়া সবাইকে তাক লাগিয়ে প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ বা নভোযান / স্যাটেলাইট পাঠায় পৃথিবীর কক্ষপথে। স্পুটনিক-১ হল মানুষের তৈরি প্রথম সফল ভাবে প্রেরিত কৃত্রিম উপগ্রহ। তার মাত্র এক মাসের মধ্যে রাশিয়া পাঠায় স্পুটনিক-২, প্রথম মিশনে ছিল না কোন মানুষ কিন্তু স্পুটনিক-২ মিশনে ছিল একজন যাত্রী, লাইকা নামের একটি কুকুর, বললে হয়ত ভুল হবে না যে লাইকা ছিল প্রথম নভোচারী যে পৃথিবীকে আবর্তন করেছিল। রাশিয়ার বিজ্ঞানীরা কুকুরকে পরীক্ষামূলকভাবে মহাশুন্যে পাঠায় বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করার জন্য, বিজ্ঞানীরা দেখতে চেয়েছিলেন রকেটের উৎক্ষেপন , যাত্রা ও মহাশূন্যের আবহাওয়া কিভাবে প্রাণীদেহের উপর প্রভাব ফেলে। দুঃখজনকভাবে লাইকার ছিল সেটাই শেষ যাত্রা, তখনকার দিনের প্রযুক্তি রকেটকে সফল ভাবে ফিরিয়ে আনা সম্ভব ছিল না, কিন্তু মিশন থেকে প্রাপ্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ভবিষ্যতের মানুষের মহাকাশ যাত্রার পথ সুগম করে। সেই পথ ধরেই ১৯৬১ সালের ১২ই এপ্রিল ভস্তক-১ ইয়ুরি গাগারিন প্রথম মানব হিসেবে মহাশুন্যে পাড়ি জমান এবং নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরে আসেন।   

চিত্রঃ বাইকানর কসমোড্রোন থেকে স্পুটনিক-২ এর যাত্রা। Credit: RSC Energia/Taken from NASA site.

লাইকা প্রথম প্রাণী হিসেবে পৃথিবীর কক্ষপথ পরিভ্রমন করে, কিন্তু সেটাই শেষ নয়, তারপর বিভিন্ন দেশ অনেক ধরনের প্রাণী মহাশুন্যে পাঠিয়েছে গবেষণার কাজে, তাদের মধ্যে রয়েছে বানর, কুকুর, বিড়াল , ইদুর ইত্যাদি। এইসব প্রাণী পাঠানোর মুল উদ্দেশ্য ছিল, মহাশূন্যে কি মানুষ টিকে থাকতে পারবে কিনা, মানুষের শরীরের উপর ধরনের প্রতিক্রিয়া হতে পারে সেটা জানার জন্য আগে থেকে অন্য প্রাণীকে পরীক্ষামূলকভাবে পাঠানো হয়েছিল। যার ফলশ্রুতিতে পরে মানুষ মহাশূন্য জয় করে, আর মানুষের এই মহাকাশ জয়ের পেছনে অবদান রয়েছে সেইসব প্রাণীদের।   

তথ্যসুত্রঃ

[1] “Laika | Background, Spaceflight, & Facts | Britannica.” Available: https://www.britannica.com/topic/Laika. [Accessed: Jun. 16, 2024]

[2] “60 years ago: The First Animal in Orbit - NASA,” Nov. 06, 2017. Available: https://www.nasa.gov/history/60-years-ago-the-first-animal-in-orbit/. [Accessed: Jun. 16, 2024]

[3] “1957: Russians launch dog into space,” Nov. 03, 1957. Available: http://news.bbc.co.uk/onthisday/hi/dates/stories/november/3/newsid_3191000/3191083.stm. [Accessed: Jun. 16, 2024]

Published Date: 16/06/2024