রকেটের ইতিহাস

প্রথম রকেট ব্যাবহারের ইতিহাস পাওয়া যায় চীনে , ১২৩২ সালে চিন এবং মঙ্গোলদের যুদ্ধে প্রথম চীনারা ব্যাবহার করে। তৎকালীন রকেটে গান পাউডার ব্যাবহার করত, পরে মঙ্গোলরাও সেটা রপ্ত করে ফেলে, পর্যায়ক্রমে ভারত , মধ্যপ্রাচ্য হয়ে ইউরোপে ছড়িয়ে পরে। চীনারা মূলত রকেট আতশবাজি হিসেবে ব্যাবহার করত, কিন্তু পরবর্তীতে রকেট এবং গান পাউডার যুদ্ধে ব্যাপকহারে ব্যাবহার শুরু হয়।

কিন্তু আধুনিক রকেটের আবিষ্কার আসলে বেশ নতুন, ১৮৯৮ সালে রাশিয়ান স্কুলশিক্ষক কন্সটানটিন ছিলকসভকি (Konstantin Tsiolkovsky) রকেটের সাহায্যে মহাকাশ অভিযানের অভিমত ব্যাক্ত করেন,  ১৯০৩ সালে তিনি একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেন, তিনি উল্লেখ করেন, তরল জ্বালানি ব্যাবহারের মাধ্যমে দূরপাল্লার রকেট তৈরি করা সম্ভব। তিনি বিভিন্ন ধাপের রকেটের মূলনীতি প্রকাশ করেন এবং দেখান যে, বহুধাপ রকেটের মাধ্যমে পৃথিবীর অভিকর্ষ বল থেকে মুক্ত হওয়া সম্ভব। কন্সটানটিন ছিলকসভকি-কে রকেট বিজ্ঞানের জনক হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু তার এই নতুন তত্ত্ব কাল্পনিক মনে হয়েছিল অনেকের কাছেই, পর্যাপ্ত পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে এই তত্ত্ব তখন বাস্তবে রূপ নিতে পারেনি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রকেটে তরল  জ্বালানির ব্যাবহার এবং বহু-ধাপ রকেট এখনো চলমান।

তারপর যুক্তরাষ্ট্রের পদার্থ বিজ্ঞানী রবার্ট গডার্ড (Robert Goddard) রকেট নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। ১৯১৯ সালে তিনি গাণিতিকভাবে ব্যাখ্যা করেন কিভাবে রকেটের মাধ্যমে অনেক উচ্চতায় পৌঁছানো সম্ভব, এখন এই পদ্দতি meteorological sounding rocket নামে পরিচিত। তিনি বিভিন্ন ধরনের জ্বালানির দিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালিয়ে বুঝতে পারেন, তরল জ্বালানির মাধ্যমে রকেট আরও ভালভাবে উড়তে সক্ষম। ১৯২৬ সালে তরল অক্সিজেন এবং গ্যাসোলিন ব্যাবহার করে প্রথম রকেট উড়াতে সক্ষম হন, যদিও রকেটটি মাত্র ১২.৫ মিটার উপরে উঠেছিল কিন্তু আধুনিক রকেটের ইতিহাসে এটি একটি নতুন অধ্যায়। পরবর্তীতে তিনি তার রকেটের আরও উন্নতি করেন, যেমন পরবর্তীতে জাইরোস্কোপ , বৈজ্ঞানিক যন্ত্র এবং প্যারাসুটও ব্যাবহার করেন, গডার্ড আধুনিক রকেটের একজন পুরুধা ব্যাক্তি ।  নাসা তার সন্মানে Goddard Space Flight Center নামে একটি গবেষণাগারের নামকরণ করে।

রকেটের ইতিহাসের আরেকজনের নাম চলে আসে, তার নাম জার্মান বিজ্ঞানী ( জন্ম: অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি) হ্যারমান ওবের্থ (Hermann Oberth) । ১৯২৩ সালে তিনি “The Rocket into Planetary Space” নামে একটি বই প্রকাশ করেন যা  ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায় এবং বিভিন্ন দেশে দেশে বিজ্ঞান ক্লাব চালু হয় এবং তরুণরা মহাকাশ ভ্রমণ এবং রকেট বানানোর প্রতিযোগিতা শুরু হয়। জার্মানিতে এইরকম একটি সমিতি চালু হয়, যার নাম ছিল, Society for Space Travel.

পরবর্তীতে জার্মান সরকার বিভিন্ন রকেট প্রকল্পে সহায়তা শুরু করে , এবং এই প্রকল্পটি পরিচালনা করেন বিখ্যাত বিজ্ঞানী ভর্নার ভন ব্রাউন , তার অধীনে জার্মানি সফল ভাবে বিভিন্ন রকেটের পরীক্ষা চালায়। তাদের তৈরি করা V2 সবচেয়ে সফল রকেট, পরবর্তিতে এই রকেটের আদলে আরও অনেক রকেট তৈরি করা হয়। তবে দুঃখজনকভাবে, এই রকেটগুলো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ্যে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয় এবং প্রচুর প্রাণহানির কারণ ঘটায়।  যুদ্ধ শেষ হলে ভর্নার ভন ব্রাউন যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসেন (যুক্তরাষ্ট্রের সরকার ভর্নার ভন ব্রাউন এবং তার অনেক সহকর্মী নিয়ে আসে যুক্তরাষ্ট্রে ) এবং পরবর্তীতে নাসায় বিভিন্ন সফল মিশন পরিচালনা করেন, যেমন এপোলো মিশন।

আর অন্যদিকে, রাশিয়ানদের মধ্যে সারগেই করলেভ নাম চলে আসে, তার অধীনে অনেক সফল অভিযান পরিচালিত হয়, যেমন প্রথম স্যাটেলাইট স্পুটনিক, প্রথম মানব মহাশূন্যে ইত্যাদি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ উত্তরকালে রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে শুরু হয় শীতল যুদ্ধ, শুরু হয় দুটি দেশের মধ্যে , মহাশূন্য জয় করার প্রতিযোগিতা। একদিক থেকে রাশিয়া প্রথম এগিয়ে যায়, প্রথম সফল কৃত্রিম উপগ্রহ পৃথিবীর কক্ষপথে প্রেরণ করে, স্পুটনিক-১ । পরবর্তীতে স্পুটনিক-২ তে পাঠানো হয় লাইকা নামের কুকুর। রাশিয়া সফল ভাবে পৃথিবীর কক্ষপথে প্রথম মানুষ পাঠায় ভস্তক-১ মিশনে, প্রথম নারী হিসেবে মহাশূন্যে ভেলেনটিনা তেরেসকোভা ভ্রমণ করেন।

স্পুটনিকের পর মহাশূন্যে জয়ের অভিযান অব্যাহত ছিল, মানুষ সৌরজগতের সবগুলো গ্রহে মিশন পরিচালনা করেছে, ১৯৬৯ সালে চাঁদে মানুষ পৌঁছানো মহাশূন্য বিজয়ের ইতিহাসে আরেক অর্জন। এপোলো-১৭ মিশনের পর মানুষ পৃথিবীর নিচু কক্ষপথের সীমানা থেকে বাইরে যায়নি। কিন্তু মানুষের তৈরি নভোযান আজকে সৌরজগতের অভ্যন্তরীণ সীমানা পাড়ি দিয়েছে, যেমন ১৯৭৭ সালে পাঠানো ভয়েজার -১ এবং ২ এখনো পৃথিবীর সাথে সংযুক্ত, ভয়েজার-১ মানুষের তৈরি করা নভোযান যা ইন্টার-স্টেলার অঞ্চলে পৌছাতে সক্ষম হয়েছে। পৃথিবী থেকে ভয়েজার -১ এবং ২ দূরত্ব যথাক্রমে ১৩৭ AU এবং ১১৪ AU (Astronomical Unit) ।  এখন আরও অধুনিক টেলিস্কোপ দিয়ে এমনকি দুর নক্ষত্রের গ্রহ সনাক্ত করা সম্ভব হচ্ছে কিন্তু মহাবিশ্বের বিশাল দূরত্ব প্রচলিত রকেট দিয়ে পাড়ি দেওয়া একজন মানুষের জীবনকালে সম্ভব হচ্ছে না আপাতত । বিভিন্ন গবেষণা চলছে কিভাবে কম সময়ে অন্য নক্ষত্র পাড়ি দেওয়া সম্ভব। হয়ত একদিন মানুষ অন্য নক্ষত্রে সেই রকেট দিয়ে পাড়ি দিবে।

Published on: 25.02.2017

তথ্যসূত্র/ Reference

[1] “Brief History of Rockets.” Available: https://www.grc.nasa.gov/www/k-12/TRC/Rockets/history_of_rockets.html. [Accessed: 2017]

[2] “Rocket History - 20th Century and Beyond.” Available: https://www.grc.nasa.gov/www/k-12/rocket/BottleRocket/20thBeyond.htm. [Accessed: 2017]

[3] “Voyager - Mission Status.” Available: https://voyager.jpl.nasa.gov/mission/status/. [Accessed: 2017]

[4] “The History of Sounding Rockets.” Available: https://www.esa.int/esapub/hsr/HSR_38.pdf [Accessed: 2017]

[5] “CHRONICLE OF SOVIET-RUSSIAN SPACE PROGRAM- Roskosmos ( Russian State Space Corporation).” Available: http://en.roscosmos.ru/174/. [Accessed: 2017]