এপোলো -১৭ : সর্বশেষ মনুষ্যবাহী চন্দ্র অভিযান

এপোলো -১৭ চন্দ্র-অভিযান , এপোলো সিরিজের সর্বশেষ মনুষ্যবাহী অভিযান। আমরা সবাই জানি প্রথম স্যাটেলাইট যা পৃথিবীর কক্ষপথে সফল ভাবে গিয়েছিল, স্পুটনিক । ভস্তক-১ মহাকাশযানে করে প্রথম মানব ইয়ুরি গাগারিন কক্ষপথে পৌছাতে সক্ষম হয়েছিলেন।  আরেকটি বিশাল মাইলফলক ছিল এপোলো-১১ অভিযান, ১৯৬৯ সালের ২১শে জুন প্রথম মানব হিসেবে নেইল আর্মস্ট্রং চাঁদের মাটিতে পা রেখেছিলেন। কিন্তু নাসা পরবর্তীতে আরও ৫ টি সফল মনুষ্যবাহী মিশন পরিচালিত করেছিল, সর্বমোট ১২ জন নভোচারী চাঁদের মাটিতে অবতরণ করেছিলেন।

১৯৭২ সালের ১১ই ডিসেম্বর নভোচারীরা চাঁদের মাটিতে শেষ বারের মত অবতরণ করেন। তারপর আর কোন মনুষ্যবাহী চন্দ্রাভিযান পরিচালিত হয়নি।

যদিও এপোলো-১১ মিশন সবচেয়ে জনপ্রিয় কিন্তু অনেকদিক থেকে এপোলো-১৭ গুরুতপুর্ন। যেমন , এই মিশন সবচেয়ে দীর্ঘ সময় চাঁদে অবস্থান করা , সবচেয়ে দীর্ঘ সময় চাঁদে গাড়ি চালানো , সবচেয়ে বেশি চাঁদের মাটির উপাদান সংগ্রহ করা। বৈজ্ঞানিক গবেষণার দিক থেকে এপোলো-১৭ অন্যতম মাইলফলক।

নভোচারী

৩ জন নভোচারী ছিলেন এই মিশনে

১। ইউজিন কারমেন

২। রোনাল্ড ইভান

৩। হ্যারিসন স্মিট

অভিযানের সময়

উৎক্ষেপণের সময় - ডিসেম্বর ৭ , ১৯৭২

চাঁদে অবতরণ - ডিসেম্বর ১১, ১৯৭২

চাঁদ থেকে উৎক্ষেপণ পৃথিবীতে ফিরে আসার জন্য - ডিসেম্বর ১৪, ১৯৭২

পৃথিবীতে প্রত্যাবর্তন - ডিসেম্বর ১৯, ১৯৭২

মিশনের প্রধান বৈজ্ঞানিক উদ্দেশ্য

এপোলো-১৭ মিশনের প্রধান বৈজ্ঞানিক উদ্দেশ্যের মধ্যে রয়েছে

  • চাঁদের ভূতাত্ত্বিক জরিপ ও চাঁদের ভূপৃষ্ঠের বিভিন্ন নমুনা সংগ্রহ করা

  • ভূতাত্ত্বিক বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা করা

  • চাঁদের কক্ষপথ থেকে আরও বিশদ পরীক্ষা এবং ছবি সংগ্রহ করা

অবতরণের স্থান Landing Site

এপোলো -১৭ চাঁদের টরাস-লিটরো  (Taurus-Littrow) নামক স্থানে অবতরণ করে।

অবস্থান

অক্ষাংশ 20.19080° N latitude,

দ্রাঘিমাংশ 30.77168° E longitude

লঞ্চ ভেহিকল এবং নভোযান (Launch vehicle and Spacecraft)

লঞ্চ ভেহিকল এবং মহাকাশযানের অন্যান্য অংশ অনেকটাই এপোলো-১১ মিশন এর মত। 

লঞ্চ ভেহিকল SATURN V LAUNCH VEHICLE
মহাকাশযান - ৩ টি অংশ নিয়ে গঠিত,

  • লুনার মডিউল

  • সার্ভিস মডিউল

  • কমান্ড মডিউল

তবে এই মিশনে অতিরিক্ত হিসেবে চাঁদে চালানোর উপযোগী গাড়ি বহন করা হয়েছিল, যা লুনার রোভিং ভেহিকল হিসেবে পরিচিত।  

লঞ্চ ভেহিকল

স্যাটার্ন -৫ রকেট লঞ্চ ভেহিকল হিসেবে ব্যাবহার করা হয়েছে।

 স্যাটার্ন -৫ রকেটের বৈশিষ্ট্য

স্যাটার্ন -৫ একটি ৩ ধাপের রকেট বা লঞ্চ ভেহিকল, সাধারণত লঞ্চ ভেহিকলের উপরের অংশে পে-লোড থাকে (এই ক্ষেত্রে লুনার মডিউল, সার্ভিস মডিউল ইত্যাদি) , লঞ্চ ভেহিকল পে-লোড বা নভোযানকে পৃথিবীর কক্ষপথের একটি নির্দিষ্ট  অবস্থানে রেখে আসে এবং বাকি পথ নভোযান নিজেই পাড়ি দেয়। সাধারণত মহাকাশযান অভিযানের পরিকল্পনা নির্ভর করে কোন ধরনের অভিযান তার উপর, যেমন, পৃথিবীর নিচু-কক্ষপথে হতে পারে, আবার উঁচু-কক্ষপথে, চাঁদের অভিযান, অন্য গ্রহে অভিযান ইত্যাদি, অভিযানের ধরনের উপর নভোযানের নকশা নির্ভর করে। তবে, স্যাটার্ন-৫ একটি অত্যন্ত শক্তিশালী রকেট, এই রকেট ৩ ধাপের রকেট আগেই বলা হয়েছে। ৩ ধাপের মানে হল, বায়ুমণ্ডলের বিভিন্ন উচ্চতা পার হওয়ার পর, সেই অংশ মুল রকেট থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং এই ভাবে একসময় সম্পূর্ণ লঞ্চ ভেহিকল রকেট পে-লোড থেকে আলাদা হয়ে যায়।

৩ ধাপ হলো

প্রথম ধাপ First Stage (S-IC)

দ্বিতীয় ধাপ Second Stage (S-II)

তৃতীয় ধাপ Third Stage (S-IVB)

এখানে উল্লেখ্য যে, প্রতি ধাপ শুধুমাত্র একটি সময় এবং নির্দিষ্ট উচ্চতায় পরিচালিত হয়।

প্রথম ধাপ First Stage (S-IC)

প্রথম ধাপটি রকেটের নিচের অংশ, এই অংশে ৫টি J-1 সিরিজের রকেট রয়েছে, এই ধাপটি চালু হয় একদম উৎক্ষেপণের মুহূর্তে, এই পাঁচটি রকেটের সাহায্যে শক্তিশালী বল উৎপন্ন হয় যা পৃথিবীর নিচের বায়ুমণ্ডল এবং অভিকর্ষ বলের প্রভাব থেকে বের হওয়ার জন্য দরকার। এই ধাপটি ২.৫ মিনিট ধরে চালু থাকে এবং নভোযানকে ৩৮ মাইল বা  ৬১ কিলোমিটার উচ্চতায় পৌঁছে দেয়।

 

দ্বিতীয় ধাপ Second Stage (S-II)

প্রথম ধাপ আলাদা হয়ে যাওয়ার পর, দ্বিতীয় ধাপ চালু হয়। দ্বিতীয় ধাপে ৫ টি J-2 রকেট রয়েছে এবং এই ধাপ পরবর্তী ৬ মিনিট ধরে চালু থেকে নভোযানকে ১১৫ মাইল বা ১৮৫ কিলোমিটার উচ্চতায় পৌঁছে দেয় এবং দ্বিতীয় ধাপ বাকি রকেট থেকে আলাদা হয়ে যায়।

 

তৃতীয় ধাপ Third Stage (S-IVB)

এটি সর্বশেষ ধাপ, এই ধাপে একটি J-2 রকেট রয়েছে, দ্বিতীয় ধাপের পর এই ধাপের রকেট চালু হয় এবং সেটি ২৭৫ মিনিট পর্যন্ত চালু থেকে নভোযানের গতিবেগ প্রায় ঘণ্টায় ১৭৫০০ মাইলে  (২৮,১৮৩ কিমি/ঘণ্টা)  পৌঁছে,  এই পর্যায়ে তৃতীয় ধাপের ইঞ্জিন বন্ধ হয় এবং একটু পর আবার চালু হয়ে নভোযানকে ট্রান্স-লুনার অরবিট বা চাঁদের যাওয়ার পথে পৌঁছে দেয় এবং একটু পড়ে এই ধাপ আলাদা হয়ে যায়। বাকি পথ নভোযান একাই পাড়ি দেয়।

মহাকাশযান বা নভোযানে প্রধানত তিনটি অংশ

 

  • লুনার মডিউল

  • সার্ভিস মডিউল

  • কমান্ড মডিউল

 

লুনার মডিউল

লুনার মডিউল আসলে দুইটি অংশে বিভক্ত, অবতরণ অংশ এবং তার উপর আরোহণ অংশ। এই দুইটি অংশ মিলে সম্পুর্ন লুনার মডিউল গঠিত। লুনার মডিউলকে বাংলায় চন্দ্রাযানও বলা হয়। সম্পূর্ণ মহাকাশযান যখন চাঁদের কক্ষপথে পৌঁছে তখন শুধু চন্দ্রাযান বা লুনার মডিউল বাকি মহাকাশযান থেকে পৃথক হয়ে চাঁদের মাটিতে অবতরণ করে এবং চাঁদের নভোচারীদের পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে চন্দ্রাযানের উপরের অংশ (আরোহণ অংশ) রকেটের সাহায্যে চাঁদ থেকে উৎক্ষেপিত হয়ে কমান্ড এবং সার্ভিস মডিউলে (CSM) ফিরে আসে। লুনার মডিউলে বিভিন বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ছাড়াও রয়েছে, দুই ট্যাঙ্ক জ্বালানি অ্যারোযিন-৫০, অক্সাইডার হিসেবে নাইট্রোজেন টেট্রাঅক্সাইড ( জ্বালানি দহনে সহায়তা করে) , পানি, অক্সিজেন ও হিলিয়াম এবং অন্যান্য বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি।

কমান্ড এবং সার্ভিস মডিউল

কমান্ড এবং সার্ভিস মডিউল মোটামুটি একসাথেই থাকে অধিকাংশ মিশনের সময়, যদিও কাজের দিক থেকে এই দুটি মডিউলের কাজের ধরন আলাদা। শুধুমাত্র কম্যান্ড মডিউল পৃথিবীতে নভোচারীদের নিয়ে ফিরে আসে কিন্তু সার্ভিস মডিউল পৃথিবীতে প্রবেশের পুর্বে আলাদা হয়ে যায়।

লুনার মডিউল বা চন্দ্রযান

 চাঁদের পৃষ্ঠ থেকে লুনার মডিউল বা চন্দ্রযান নভোচারীদের নিয়ে ফিরে  আসে কমান্ড এবং সার্ভিস মডিউলে (CSM)। নভোচারীরা লুনার মডিউল থেকে কমান্ড মডিউলে চলে আসে এবং লুনার মডিউল ফেলে আসেন চাঁদের কক্ষপথে যা পরবর্তিতে চাঁদের মাটিতে পতিত হয়।  লুনার মডিউল ১৫ ই ডিসেম্বর ১৯৭২ কমান্ড এবং সার্ভিস মডিউলে (CSM) ফিরে আসে। অবশেষে কমান্ড এবং সার্ভিস মডিউলে (CSM) নভোচারীদের নিয়ে ১৯ শে ১৯৭২ সালে পৃথিবীতে ফিরে আসে। ৩ জন নভোচারীসহ কমান্ড মডিউল প্রশান্ত সাগরে অবতরণ করে , তারপর যুক্তরাষ্ট্রের নৌবাহিনী তাদের জাহাজে  নভোচারীদের নিয়ে আসে।  



তথ্য সূত্র

  1. Apollo-17 Mission. NASA.  https://www.nasa.gov/mission_pages/apollo/missions/apollo17.html

  2. APOLLO 17 (AS-512) . Smithsonian National Air and Space Museum. https://airandspace.si.edu/explore-and-learn/topics/apollo/apollo-program/landing-missions/apollo17.cfm

  3. APOLLO 17, Smithsonian National Air and Space Museum.
    https://airandspace.si.edu/explore-and-learn/topics/apollo/apollo-program/landing-missions/apollo17-facts.cfm

  4. APOLLO 17 LANDING SITE. Smithsonian National Air and Space Museum.
    https://airandspace.si.edu/explore-and-learn/topics/apollo/apollo-program/landing-missions/apollo17-landing-site.cfm

  5. APOLLO 17 MISSION OBJECTIVES. Smithsonian National Air and Space Museum.
    https://airandspace.si.edu/explore-and-learn/topics/apollo/apollo-program/landing-missions/apollo17-objectives.cfm

  6. Lunar Geology Investigation. Smithsonian National Air and Space Museum.
    https://airandspace.si.edu/explore-and-learn/topics/apollo/apollo-program/landing-missions/apollo17-science.cfm

  7. Apollo-17. Wikipedia. https://en.wikipedia.org/wiki/Apollo_17

  8. Lunar water. Lunar and Planetary Institutes.  http://www.lpi.usra.edu/science/LunarWater/

  9. The Apollo Lunar Roving Vehicle. NASA. http://nssdc.gsfc.nasa.gov/planetary/lunar/apollo_lrv.html

  10. Apollo 17 Lunar Module /ALSEP. NASA.  http://nssdc.gsfc.nasa.gov/nmc/masterCatalog.do?sc=1972-096C

  11. Apollo 17 Command and Service Module (CSM). NASA. http://nssdc.gsfc.nasa.gov/nmc/spacecraftDisplay.do?id=1972-096A

  12. https://airandspace.si.edu/explore-and-learn/topics/apollo/apollo-program/landing-missions/apollo17.cfm

  13. Landing Site, Smithsonian National Air and Space museum. https://airandspace.si.edu/multimedia-gallery/5480640jpg?id=5480

  14. https://airandspace.si.edu/explore-and-learn/topics/apollo/apollo-program/spacecraft/lrv.cfm

প্রকাশের সময়- ফেব্রুয়ারী ১৩, ২০১৭